সিলেট-১ আসন বাংলাদেশের সংসদীয় ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন একটি সংসদীয় আসন। ৫৩ বছরের ইতিহাস সাক্ষী যেই এই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন তাঁর দলই সরকার গঠন করেছেন। শুধু তাই নয়, ৫৩ বছরের মধ্যে অন্তত: ৪৫ বছর যেই এই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন তিনি হয় অর্থমন্ত্রী (যেমন এম সাইফুর রহমান ও আবুল মাল আব্দুল মুহিত) না হয় স্পীকার (যেমন হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী) আর না হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রী (যেমন ড. এম এ মোমেন) হয়েছেন।
মজার ব্যাপার হচ্ছে এম সাইফুর রহমান ও আবুল মাল আব্দুল মুহিত বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘতম সময় অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা দু’জন ব্যক্তিত্ব। তারা পরস্পর বন্ধু ছিলেনও বটে, সেই ছাত্রজীবন থেকে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সংসদে অর্থমন্ত্রী হিসেবে সবচেয়ে বেশী সংখ্যক বাজেট পেশ করেছেন এই দু’জন ব্যক্তিত্ব। তারা দু’জন অবাধ ও সুষ্ট নির্বাচনের সময় যখন সিলেট-১ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতেন তখন তুমুল হাড্ডা-হাড্ডি লড়াই হতো। দিন শেষে যার দল সরকার গঠন করতো সেই দল থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতেন! অর্থাৎ বিএনপি সরকার গঠন করলে এম সাইফুর রহমানই এমপি নির্বাচিত হয়ে আসছেন। অপরদিকে আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করলে আবুল মাল আব্দুল মুহিত এমপি নির্বাচিত হয়ে আসছেন। আর এজন্য সিলেটের জনগণের মুখে মুখে কয়েকটি কথা বহুল প্রচারিত: সিলেট-১ আসন মর্যাদাপূর্ণ আসন, সিলেট-১ আসন ভিআইপি আসন, সিলেট-১ আসনে যে পাশ করে তাঁর দলই সরকার গঠন করে!
আগামী সংসদ নির্বাচন যেটা হতে যাচ্ছে সেটা অবাধ, সুষ্ট ও নিরপেক্ষ হবে বলে সবাই আশা ও প্রত্যাশা করছেন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও এ ব্যাপারে বদ্ধপরিকর। আর এ লক্ষেই তারা প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে চাচ্ছেন। আওয়ামীলীগ তো মাঠে নেই। সহসা তারা আবার মাঠে ফিরতে পারবে বলে মনে হয় না। দল হিসেবে আওয়ামীলীগকে গণহত্যার দায়ে নিষিদ্ধ ঘোষনার দাবী উঠছে বিভিন্ন মহল থেকে। আওয়ামীলীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার চলছে। মামলাগুলোর নিষ্পত্তিকালে ট্রাইব্যুনাল কি অবজারভেশন দেন এবং দেশের উদ্ভুত পরিস্থিতি কোন দিকে কখন মোড় নেয় তা দেখার জন্য আরোও অপেক্ষা করতে হবে। তবে এটা বলা যায় যে এক সময়ের শক্তিশালী রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগ নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে অত্যাবশ্যকীয় হবার সম্ভাবনা নেই।
আগামী সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ট ও নিরপেক্ষ হলে বিএনপিই যে সরকার গঠন করবে এটা মোটামুটি নিশ্চিত করে বলা যায়। এখনই বা আগামী তিন-ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন হলে বিএনপি দুই-তৃতীয়াংশ আসন নিয়ে ক্ষমতায় যাবার সম্ভাবনা আছে। নির্বাচন যত দেরী হবে আসন সংখ্যা কমতে পারে। অতীতের ধারাবাহিকতা ও ঐতিহাসিকভাবে প্রমানের ভিত্তিতে বলা যায় যে সিলেট-১ আসনে বিএনপির প্রার্থীই বিজয়ী হবেন। কিন্তু যারা সিলেট-১ আসন নিয়ে কাজ করছেন বা যারা এই আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী তারা তো সব স্থানীয় রাজনীতিবিদ। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভূমিকা রাখা বা পরিচিত হওয়া তো দূরের কথা, জাতীয়ভাবেও তারা পরিচিত নন। তেমন যোগ্যতাসম্পন্নও বলে মনে হয় না। তাই গণ-অভ্যূত্থান-পূর্ব জোয়ারের টানে বিএনপির নমিনেশনে প্রার্থী হয়ে বিজয়ী হলেও তারা অর্থমন্ত্রী, স্পীকার বা পররাস্ট্রমত্রী হবার মতো যোগ্য ব্যক্তি নন মোটেই। সিলেট-১ আসনের জনগণ, বিশেষ করে বিএনপির হাইকমান্ড এ ব্যাপারে কি কোন চিন্তা করছেন?
বিএনপির প্রতিষ্টাতা স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ছিলেন এক ক্ষনজন্মা পুরুষ, ছিলেন এক ভিশনারী রাষ্ট্রপতি। তাঁর কট্ট্রর রাজনৈতিক বিরোধীরাও তাঁর ব্যক্তিগত সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন নি। তিনি ছিলেন এক সফল রাষ্ট্রনায়ক। তাঁর সুদূর প্রসারী চিন্তা, দেশ গঠনের কর্মসূচী, জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার দর্শন ও যোগ্য লোককে বাঁছাই করার পদ্ধতি তাঁর রাষ্ট্রনায়কোচিত চিন্তার সাক্ষ্য বহন করে। ইংরেজীতে একটি কথা আছে “Politicians think for the next election, Statesmen think for the next generation” (অর্থাৎ “রাজনীতিবিদরা ভাবেন পরবর্তী নির্বাচন নিয়ে, রাষ্ট্রনায়করা ভাবেন পরবর্তী প্রজন্ম নিয়ে”)।
এম সাইফুর রহমান ছিলেন অনেকটা ব্যতিক্রমী টাইপের ব্যক্তিত্ব। সোজা সাফটা কথা বলতেন। মনে যা আসে তাই সাহস করে অন্যের মুখের উপর বলতে পারতেন। শুদ্ধ বাংলা তেমন একটা বলতে পারতেন না। তাঁর ভাষা ছিল ইংরেজী ও সিলেটি। আমলারা তাঁর ভয়ে কাঁপতেন, তাদের দৌড়ের উপর রাখতে পারতেন তিনি। রাজনীতির মারপ্যাঁচ তেমন একটা বুঝতেন না। তবে এটা স্বীকার করতে হবে যে বাংলাদেশে অর্থনীতির ভীত রচিত হয়েছে তাঁর হাত দিয়েই। ভ্যাট ও মুক্তবাজার অর্থনীতিসহ বেশ কিছু আর্থিক ও মুদ্রা নীতি চালুর ক্ষেত্রে তাঁর যুগান্তকারী ভূমিকা ছিল। বাংলাদেশে সর্বোচ্চ সংখ্যক গুনগত বাজেট তাঁর হাত দিয়েই সংসদে উপস্থাপিত হয়েছে। এসব কিছুর জন্য সাবেক সফল অর্থমন্ত্রী মরহুম এম সাইফুর রহমান ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। তবে এর আগে ধন্যবাদ পাওয়ার দাবীদার শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কেননা তিনিই এম সাইফুর রহমানের মতো ব্যক্তিত্বকে pick up (কুড়িয়ে তোল) করে রাজনীতিতে নিয়ে এসেছিলেন এবং সঠিক জায়গায় বসিয়েছিলেন।
শুধু এটাই নয়, এমন ভূরিভূরি উদাহরণ দেয়া যাবে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কিভাবে যোগ্য লোকদের pick up করতেন। তাঁর মধ্যে আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি ড. মাহাথির মুহাম্মদের এই গুনটি দেখতে পেয়েছি। ড. মাহাথির মুহাম্মদ তাঁর দীর্ঘ প্রিমিয়ারশীপে ইংল্যান্ডে এসে ট্যালেন্ট হান্টিং করতেন – দক্ষ ও প্রতিষ্ঠিত মালয়েশিয়ান নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে নিতে ওয়ান-টু-ওয়ান যোগাযোগ করতেন। তিনি বলতেন “তোমাকে মালয়েশিয়ায় যেতেই হবে। এখানে যে বেতন ও সুযোগ সুবিধা পাও তা আমরা ম্যাচিং করবো, প্রয়োজনে এর চেয়ে বেশী আমরা দেব। তারপরও তোমাকে মালয়েশিয়ায় যেতে হবে। তোমার দরকার মালয়েশিয়ার”। এ ধরণের একটি মিটিং-এ আমার থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের যোগ্য উত্তরসূরি আগামী বাংলাদেশের সম্ভাব্য কান্ডারী তারেক রহমান। বেশ কয়েক বার সাক্ষাতে তাঁর মধ্যে বেশ কিছু অভাবনীয় গুন লক্ষ্য করেছি। কিছু গুন তাঁর উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। তাঁর শ্রদ্ধেয় পিতা ও মাতার মতো তিনি বলেন কম, শুনেন বেশী। যেটা বলেন দরকারী কথাই বলেন। ওয়ান-টু-ওয়ান ব্যবহার তাঁর অত্যন্ত চমৎকার ও বিনয়ী। দেশকে নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে দেখেছি। দীর্ঘ দেড় দশকের কঠিন ফ্যাসিবাদের সময়ের মধ্যেও মোটাদাগে দলকে ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত রাখতে পেরেছেন। তাঁর কথাবার্তায় রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শীতা ফুটে উঠে। কয়েক বছর আগে ফাঁস হওয়া কল্যান পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব:) ইব্রাহীমের সাথে তাঁর টেলি-কথোপকথনে তাঁর রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা ফুটে উঠেছে। তিনি কি পারবেন তাঁর শ্রদ্ধেয় পিতা ও ড. মাহাথির মুহাম্মদের মতো বাংলাদেশ বিনির্মানে ট্যালেন্ট হান্টিং করতে? এম সাইফুর রহমানের মতো অসংখ্য যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিত্বদের দলের বাহির থেকে কুড়িয়ে এনে (pick up করে) আগামীর বাংলাদেশ গঠনে তাদের কাজে লাগাতে?
ফিরে আসি সিলেট-১ আসনে। শুধু সিলেট-১ আসনেই নয় বরং বৃহত্তর সিলেটে চলছে জাতীয় মানের গভীর নেতৃত্ব সংকট। আওয়ামীলীগে তো নয়ই, থাকলেও তারা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অপাংক্তেয়। বিএনপিতেও নেই। স্বাধীনতার পর থেকে বৃহত্তর সিলেট থেকে নির্বাচিত সাংসদরা বলতে গেলে দেশ চালিয়েছেন, গুরুত্বপূর্ন মন্ত্রনালয়সমুহে দাপটের সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। সেই প্রবণতা (trend) নীচের দিকে আসতে আসতে অনেকটা প্রায় শুন্যে চলে এসেছে। আগামী নির্বাচনে যারা বৃহত্তর সিলেট থেকে প্রার্থী হবেন বলে যাদেরকে দেখছি বা যাদের নাম শুনছি তাদের মধ্যে জাতীয় পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ন দায়িত্ব পালন করা ও গুরুত্বপূর্ন মন্ত্রনালয় চালানোর মতো ব্যক্তিত্ব চোখে দেখছি না।
সর্ম্পকিত খবর:: বাবাই আমাদের অনুপ্রেরণার বাতিঘর
সিলেট-১ আসন অত্যন্ত মর্যাদার আসন, ভিআইপি আসন। এই আসন জাতীয় পর্যায়ে বহুবার ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। সেই ইতিহাস ও ঐতিহ্যের যেন ধারাবাহিকতা থাকে এ ব্যাপারে বিএনপির হাইকমান্ডকে সচেষ্ট হতে হবে। তার পাশাপাশি এই আসনের সচেতন ভোটারদেরও সজাগ থাকতে হবে। গণ-অভ্যূত্থানের পর সৃষ্ট হওয়া পরিস্থিতিতে বড় দল বিএনপি থেকে কলাগাছ প্রার্থী হলেও বিজয়ী হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। তবে আমরা কলাগাছ সদৃশ বা যেনতেন প্রার্থীকে এমপি বানিয়ে এই আসন থেকে সংসদে পাটাতে চাই না। বরং এমন একজন প্রার্থীকে আমরা সংসদে পাঠাতে চাই যার অতীত ঐতিহ্য রক্ষা করে স্পীকার বা অর্থমন্ত্রী বা পররাস্ট্র মন্ত্রী বা অনুরূপ গুরুত্বপূর্ন মন্ত্রী হওয়ার মতো যোগ্যতা, দক্ষতা ও আন্তর্জাতিক পরিচিতি আছে।
নাজির আহমদ: বিশিষ্ট আইনজীবী, রাষ্ট্রচিন্তক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং