শায়খে বিশ্বনাথী রাহ. ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। ভারত, পাক ও বাংলাদেশ—ত্রিকালেই তিনি রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন। শায়খের প্রধান পরিচয়টা জমিয়ত কেন্দ্রিক। পাক আমলে তাঁর ঐতিহাসিক চিঠির সূত্রধরে এ দেশে জমিয়তের কার্যক্রমের সূচনা হয়।
সিলেট জেলা জমিয়তের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক থেকে কেন্দ্রীয় সভাপতি পর্যন্ত বহু স্তরে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। এ দেশে জমিয়তের প্রতিষ্ঠা ও বিস্তারে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জমিয়ত তাঁকে বাবায়ে জমিয়ত বা জমিয়ত জনক উপাধিতে ভূষিত করেছে। শায়খের জীবন উৎসর্গকৃত প্রতিষ্ঠান জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া, বিশ্বনাথ, সিলেট।
প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল হিসেবে তাঁর সুদক্ষ পরিচালনায় ছোট্ট পাঠশালা থেকে খুব কম সময়ে জামিয়াটি দেশের বৃহৎ দ্বীনি প্রতিষ্ঠান পরিণত হয়। নারী শিক্ষা বিস্তারে তিনি আশির দশকে জামিয়া মাদানিয়া কওমিয়া মহিলা মাদরাসা, বিশ্বনাথ প্রতিষ্ঠা করেন। আমৃত্যু তিনি প্রতিষ্ঠান দুটির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। ইসলামী সাহিত্য ও সাংবাদিকতায়ও তিনি অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন। রচনা করেছেন এক ডজন বই। এছাড়াও তাঁর সম্পাদনায় নব্বইয়ের দশকে মাসিক আল ফারুক প্রকাশিত হয়।
শায়খে বিশ্বনাথী রাহ. দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে নিজ চোখে দেখা গণতান্ত্রিক পদ্ধতির ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন ব্যবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে ২০০২ সালে মাসিক আল ফারুক-এর আগস্ট সংখ্যায় ‘পার্টি সিস্টেম ইলেকশন ফর্মুলা’ জাতির সামনে উপস্থাপন করেন। তাঁর প্রস্তাবিত ইলেকশন ফর্মুলা নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে অক্টোবর মাসে তিনি এ ফর্মুলার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেন।
স্বৈরশাসন পরবর্তী বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে—এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে বিতর্ক শুরু হয়েছে। জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামি, ইসলামী আন্দোলন, সিপিবি, গণসংহতি আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ, এবি পার্টির মতো দলগুলো বলছে বৈষম্যহীন নির্বাচন ব্যবস্থা ও ত্রুটিমুক্ত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় পার্টি সিস্টেম ইলেকশন ফর্মুলার বিকল্প নেই। দলগুলো মৌলিকভাবে পার্টি সিস্টেমে একমত হলেও অনুষঙ্গিক ইস্যুতে বিভক্ত মতামত পেশ করছে। বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনগুলো বিশ্লেষণ করলে বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থার বিপরীতে পার্টি সিস্টেম নির্বাচন গ্রহণ করতে যে কেউ একমত হবেন।
১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি পেয়েছিল প্রদত্ত ভোটের ৩০.৮%, আর আসন পেয়েছিল ১৪০টি। আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৩০.১% ভোট, আর আসন পেয়েছিল ৮৮টি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৩৭.৪% ভোট, আর আসনের সংখ্যা ছিল ১৪৬টি। বিএনপি পেয়েছিল ৩৩.৬% ভোট, আর আসন সংখ্যা ছিল ১১৬টি।
এই দুটি নির্বাচন যদি পার্টি সিস্টেম পদ্ধতিতে হতো তাহলে ফলাফল হতো—১৯৯১ সালের ভোটের হিসেবে বিএনপির প্রাপ্ত ভোট ছিল ৩০.৮%। সে অনুযায়ী সিট পেত ৯৩টি। আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৩০.১% ভোট। সে অনুযায়ী আসন পেত ৯০টি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৩৭.৪%। সে হিসেবে আওয়ামী লীগ সিট পেত ১১৩টি, আর বিএনপির ভোট ছিল ৩৩.৬%। সে হিসেবে তারা আসন পেত ১০১টি।
শায়খে বিশ্বনাথী রাহ.’র প্রস্তাবিত পার্টি সিস্টেম ইলেকশন ফর্মুলাটি হুবহু তুলে ধরা হলো—
“ব্যক্তিকে নির্বাচন না করে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে দলকে নির্বাচন করা হবে। আর এ দলভিত্তিক নির্বাচনে যে দল যা ভোট পাবে, তন্মধ্যে প্রতি ২০০,০০০ (দুই লাখে—দৃষ্টান্তস্বরূপ) একজন প্রতিনিধি জাতীয় সংসদের জন্য মনোনয়ন করা হবে। এবং প্রত্যেক দল তার প্রাপ্ত ভোট অনুপাতে তার দলের পক্ষ থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য মনোনীত করবে। এতে করে যারা দশ লক্ষ ভোট পাবে, তাদের থাকবেন পাঁচ জন সংসদ সদস্য, আর যারা এক কোটি ভোট পাবে, তাদের থাকবেন পঞ্চাশ জন। এর বেশি যারা পাবে, তারাও এ অনুপাতে সদস্য মনোনীত করে নেবেন এবং সকল সদস্য মিলেই দেশ পরিচালনা করবেন। যাতে করে দেশের সকল জনসাধারণের প্রতিনিধিত্ব সংসদে থাকে। অন্যদিকে সবচেয়ে বেশি সংসদ সদস্য যাদের হবেন, সে দল থেকেই একজনকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর ওপরে থাকবে ৫/৭ সদস্যবিশিষ্ট একটি উপদেষ্টা কমিটি বা মজলিসে খাস। প্রধানমন্ত্রী ঐ উপদেষ্টা কমিটির পরামর্শক্রমে যে কোনো দলের উপযুক্ত ব্যক্তিদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন ও মন্ত্রণালয় বণ্টন করবেন। এতে বিরোধী দল বলে কিছু থাকবে না, তবে সরকারের অন্যায়, সংবিধান পরিপন্থী বা দেশ ও জাতির জন্য ক্ষতিকর যে কোনো পদক্ষেপের বিরুদ্ধে যে কেউ প্রতিবাদ করার অধিকার রাখবে এবং সরকারও সরল মনে তা বিবেচনা করবে। সকল দলই সরকারের অন্তর্ভুক্ত হবে এবং সকল দলই মনে করবে, এ সরকার আমাদের সরকার।”
জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে পিআর বা পার্টি সিস্টেম ইলেকশনে বড় অন্তরায় ছিল আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গ। ডান, বাম মিলিয়ে ডজন খানেক রাজনৈতিক দলের প্রস্তাবিত পার্টি সিস্টেম পদ্ধতি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের সুযোগ হিসেবেই বর্ণনা করেছে বিএনপি। এখন আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞার ফলে আগামী নির্বাচনে দলটির অংশগ্রহণ অসম্ভব হয়ে উঠেছে। বিএনপি নেতারা পার্টি সিস্টেমে যাওয়ার পথে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের শঙ্কার সাথে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার কাঠামোকে অন্তরায় মনে করছেন।
কথা হচ্ছে সংসদ সদস্যগণ দেশের আইন প্রণেতা। আমাদের দেশে সাংসদ হতে যোগ্যতার কোনো প্রশ্ন নেই। সাংসদ নিজ আসনে দাঁড়িয়ে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। অনেকে লিখিত বক্তব্য পাঠও ভালোভাবে করতে পারেন না। সাংসদরা আইন প্রণয়নের চেয়ে সংসদীয় এলাকার উন্নয়নের দিকে বেশি মনোযোগী থাকেন। যেন উন্নয়নই তাঁর কাজ। ফলে স্থানীয় সরকার শক্তিশালী হয় না। শক্তিশালী স্থানীয় সরকার না হলে পার্টি সিস্টেম ইলেকশনের পর বৈষম্যহীন উন্নয়ন সম্ভব হবে না। তখন সাংসদ নির্ধারণ করবে দল। আসনের বিবেচনা থাকবে না। ফলে এক অঞ্চল থেকে অস্বাভাবিক সংখ্যক সাংসদ মনোনীত হতে পারেন। তাছাড়া এখনকার মনোনয়ন ফরম বাণিজ্য তখন সাংসদ পদ বাণিজ্যে পরিণত হতে পারে। এ ক্ষেত্রেও অযোগ্য সাংসদ থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়ে যাবে।
এজন্য পার্টি সিস্টেম ইলেকশন ফর্মুলায় যাওয়ার আগে স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণসহ রাষ্ট্রীয় কাঠামো, নির্বাচন সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রসঙ্গ এবং রাজনৈতিক দলসমূহে প্রয়োজনীয় সংস্কার নিশ্চিত করতে হবে।
উল্লেখ্য: বিশ্বনাথের গড়গাঁও গ্রামে জন্ম নেওয়া আল্লামা শায়খ আশরাফ আলী বিশ্বনাথী রাহ. আজকের তারিখ ২০ মে ২০০৫ ইংরেজি, শুক্রবার ইন্তেকাল করেন।
আরও পড়ুন:: মর্যাদাপূর্ণ সিলেট-১ আসন: বিএনপি ও তারেক রহমানকে যা ভাবতে হবে।