কিশোরগঞ্জের ইটনায় তিন হাজারের বেশি কবর খোঁড়া কবর খননকারী মনু মিয়া (৬৭) আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। শনিবার (২৮ জুন) সকাল সাড়ে ৯টার দিকে জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের আলগাপাড়া গ্রামের নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রীসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
মনু মিয়ার মৃত্যু নিশ্চিত করেছেন তাঁর ভাতিজা শফিকুল ইসলাম। তিনি জানান, মনু মিয়া দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিসসহ বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। ছয় দিন আগে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরেছিলেন। মনু মিয়ার মৃত্যুর পর কিশোরগঞ্জসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শোকের ছায়া বইছে।
কবর খোঁড়ার জন্য বিভিন্ন এলাকায় ছুটে যাওয়া মনু মিয়া ঘোড়ার পিঠে চড়ে কাজ করতেন। অসুস্থ হয়ে তিনি হাসপাতালে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন এবং দুর্বৃত্তরা তার ঘোড়াটিকে মেরে ফেলেছিল।
মনু মিয়ার স্বজনরা জানান, তিনি জীবনের অধিকাংশ সময় কবর খোঁড়ার কাজে ব্যস্ত ছিলেন, যার কারণে শরীরে নানা রোগ বাসা বাঁধে। তিনি কখনোই নিজেকে গুরুত্ব দেননি। দীর্ঘদিন ধরে এই কাজটি বিনা পারিশ্রমিকে করেছিলেন। তার ডায়েরি অনুসারে, তিনি এই সময়ে অন্তত ৩,০৫৭টি কবর খুঁড়েছেন।
কবর খুঁড়তে আরও দ্রুত পৌঁছানোর জন্য কয়েক বছর আগে মনু মিয়া নিজের ধানি জমি বিক্রি করে একটি ঘোড়া কিনেছিলেন। সেই ঘোড়াটি ছিল তার কাজের প্রধান সঙ্গী। তবে, দুর্বৃত্তরা তার অনুপস্থিতিতে ঘোড়াটিকে মেরে ফেলেছিল। এই ঘটনায় গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর দেশে-বিদেশে অনেকেই তাকে সহায়তা করতে চেয়েছিলেন। তবে মনু মিয়া কারও সাহায্য গ্রহণ করেননি, শুধুমাত্র সুস্থতার জন্য দোয়া চেয়েছিলেন।
ঢাকার আইনজীবী এবং এলাকার সন্তান অ্যাডভোকেট শেখ মোহাম্মদ রোকন রেজা জানান, কিছুদিন আগে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন মনু মিয়া। সেই সময় দুর্বৃত্তরা তার বহু বছরের সঙ্গী প্রিয় ঘোড়াটিকে হত্যা করে, যা তাকে মানসিকভাবে গভীরভাবে ভেঙে ফেলেছিল।
রোকন রেজা বলেন, “আমি হাসপাতালে তাকে দেখতে গিয়ে বলেছিলাম—অনেকে আপনাকে নতুন ঘোড়া কিনে দিতে চায়। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘আমি এই কাজ করি শুধু আল্লাহকে খুশি করতে। মানুষের কাছ থেকে কিছু নিতে চাই না।'”
ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান বাহাউদ্দিন ঠাকুর বলেন, “ঘোড়ার মৃত্যুর পর থেকেই মনু মিয়া শারীরিকভাবে আরও দুর্বল হয়ে পড়েন। চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরে এলেও আর আগের মতো হয়ে উঠেননি। তার মৃত্যুতে আমরা একজন দয়ার সাগর, নিঃস্বার্থ মানুষকে হারালাম। এমন মানুষের অভাব কখনো পূরণ হওয়ার নয়।”
মনু মিয়ার কবর খননের সুনাম কিশোরগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছিল। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মনির উদ্দিন জানান, তিনি রাজধানী বনানী কবরস্থানে কাজ করেছেন এবং তাঁর সুনাম দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। শুধু কবর খনন করেই ক্ষান্ত হননি মনু মিয়া। তিনি যাদের কবর খুঁড়েছেন, তাদের মৃত্যুর দিন ও তারিখ সব মনোযোগ দিয়ে লিখে রেখেছিলেন। এ কারণে মনু মিয়া সবার কাছে “শেষ ঠিকানার কারিগড়” হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
আরও পড়ুন:: হংকংয়ের বিপক্ষে হামজার ম্যাচ হতে পারে সিলেটে।