নিজস্ব প্রতিবেদক :: পরকীয়ার জেরে সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার অলংকারী ইউনিয়নের রহিমপুর (পূর্বপাড়া) গ্রামে অগ্নিসংযোগে ৬জন দগ্ধ হয়ে একজন নিহতের চাঞ্চল্যকর ঘটনায় দায়ের করা মামলার প্রধান আসামী আরশ আলীকে (৪২) মৃত্যুদণ্ড ও রেহেনা বেগমকে (৩০) যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। আজ বৃহস্পতিবার সিলেটের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ ৪র্থ আদালতের বিচারক সায়লা শারমিন এই রায় প্রদান করেন। আরশ আলী রহিমপুর (পূর্বপাড়া) গ্রামের মৃত হুসন আলীর পুত্র এবং রেহেনা বেগম একই গ্রামের ফরিদ মিয়ার স্ত্রী। বিষয়টি নিশ্চিত করেন বাদী পক্ষের আইনজীবী রাজু ভৌমিক।
২০১৮ সালের ২৮ আগস্ট দিবাগত রাতে নিজ বসত ঘরে আগুনে দগ্ধ হন রহিমপুর পূর্বপাড়া গ্রামের ফারুক মিয়া (৫০), তার স্ত্রী চম্পা বেগম (৪৫), মেয়ে রিফা বেগম (১৮), ছেলে এমাদ উদ্দিন (১৪), ইমরান আহমদ (১২), নিজাম উদ্দিন (১০)। আহতদের অবস্থা আশংকাজনক হওয়ায় চিকিৎসকের পরামর্শে তাদেরকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয় এবং সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চম্পা বেগম মৃত্যুবরণ করেন। কয়েলের আগুন থেকে অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হয়েছে বলে প্রতিবেশী লোকদের এমন বক্তব্যের ভিত্তিতে ঘটনার পরদিন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ‘কয়েলের আগুন থেকে অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হয়েছে’ বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়। কিছুদিন পরবর্তীতে স্থানীয় সাংবাদিকদের সাথে নিয়ে পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গেলে সেই পুড়া কয়েলের ছাই ও অবশিষ্ট অংশ অক্ষত দেখতে পান এবং অগ্নিদগ্ধ পরিবারের সদস্যদের বক্তব্য ও সন্দেহভাজন লোকজন আত্মগোপন করায় ঘটনাটি রহস্যজনক মনে হয় এবং এ বিষয়ে দৈনিক সিলেটের ডাক-এ সংবাদ প্রকাশিত হয়।
এ ঘটনায় নিহত চম্পা বেগমের ভাই উপজেলার অলংকারী ইউনিয়নের টেংরা গ্রামের মৃত আবদুল মছব্বিরের পুত্র সফিক মিয়া বাদি হয়ে ওই বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে বিশ্বনাথ থানায় মামলা দায়ের করেন (মামলা নং-২১)। এক পর্যায়ে পুলিশ নিশ্চিত হয় এটি হত্যার উদ্দেশ্যে একটি পরিকল্পিত অগ্নিসংযোগের ঘটনা। এরপর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় প্রযুক্তির মাধ্যমে ভিকটিম ফারুক মিয়ার ছোট ভাই ফরিদ মিয়ার স্ত্রী ঘটনার মূল সন্দেহভাজন রেহেনা বেগম ও তার ভগ্নিপতি একই গ্রামের মৃত হুসন আলীর পুত্র আরশ আলীর অবস্থান শনাক্ত করে পুলিশ। এরপর ওই বছরের ৫ অক্টোবর মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলা থেকে রেহেনা বেগমকে ও ৯ অক্টোবর রাতে সিলেট নগরী থেকে আরশ আলীকে গ্রেপ্তার করে থানা পুলিশ। গ্রেপ্তারের পর পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞসাবাদে রেহেনা বেগম ও আরশ আলী ঘটনার দায় স্বীকার করে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বিশ্বনাথ থানার এসআই স্বাধীন তালুকদার ডিসি কোর্স প্রশিক্ষণে চলে গেলে থানার এসআই মিজানুর রহমানকে এই মামলার পরবর্তী কার্যক্রম সম্পাদনের দায়িত্ব দেন থানার অফিসার ইন-চার্জ শামসুদ্দোহা পিপিএম। ঘটনার মূল সন্দেহজনক আরশ আলী ও রেহেনা বেগমের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রাথমিক ভাবে সত্যতা পাওয়ায় আরশ ও রেহেনাকে অভিযুক্ত করে ২০১৯ সালের ২৩ মার্চ আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশীট) দাখিল করেন এসআই মিজানুর রহমান।
পুলিশের দেয়া অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, ভিকটিম ফারুক মিয়ার সৎ বোনের স্বামী হচ্ছেন গ্রেপ্তার হওয়া আরশ আলী ও সৎ ভাইয়ের স্ত্রী রেহেনা বেগম। সেই সুবাদে ফারুক মিয়ার বাড়িতে রেহেনা বেগমের ঘরে সব সময় যাওয়া করতেন ঘটনার মূলহোতা আরশ আলী। স্বামী ফরিদ মিয়া প্রবাসে থাকাবস্থায় রেহেনার সাথে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠে তাদের বাড়ির ২/৩ জন পুরুষের। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রেহেনার সঙ্গে পরকীয়া প্রেমের অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তুলেন আরশ আলী। এরপর থেকে অবাদে রেহেনার সঙ্গে মেলামেশা করতে থাকেন আরশ। ঘটনার কিছু দিন পূর্বে জনৈক চান মিয়ার বসত ঘরের একটি কক্ষে অবৈধভাবে মেলামেশা করা অবস্থায় দেখে ফেলেন ভিকটিম চম্পা বেগম। এই অনৈতিক কর্মকান্ড দেখে তা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না ফারুক মিয়া, তার স্ত্রী চম্পা বেগম, মেয়ে রিপা বেগম ও পুত্ররা।
বিষয়টি নিয়ে স্থানীয়ভাবে একাধিকবার শালিস বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়। এতে ফারুক মিয়া ও তার পরিবারের সদস্যদের প্রতি চরম ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন আরশ আলী ও রেহেনা বেগম। তারা ফারুক মিয়ার পরিবারের ক্ষতি সাধন করার চেষ্টা করে ও বিভিন্ন সময়ে হুমকি প্রদান করে। এক পর্যায়ে ফারুক মিয়ার ঘরে আগুন দেওয়ার পরিকল্পনা নেয় আরশ ও রেহেনা। তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘটনার ২দিন আগে দক্ষিণ সুরমা উপজেলার কামাল বাজারস্থ (আনন্দ বাজার) একটি দোকান থেকে ২ লিটার পেট্রোল ক্রয় করে নিয়ে আসে আরশ। ঘটনার দিন রাত আনুমানিক আড়াইটায় ঘটনাস্থলে গিয়ে রেহেনা বেগমের দরজায় কড়া নাড়ে আরশ। এসময় ঘর থেকে বের হয়ে রেহেনা ও আরশ পরিকল্পনা অনুযায়ী ফারুক মিয়ার বসতঘরের দরজার ভাঙ্গা অংশ দিয়ে পেট্রোল ঢেলে দিয়াশলাই (ম্যাচ) এর কাটি দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং ঘটনার পর কয়েলের আগুন থেকে অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হয়েছে বলে তারা (আরশ ও রেহেনা) লোকমুখে প্রচার করতে থাকে।