বিশ্বনাথনিউজ২৪ :: বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে গণধর্ষণের শিকার হয়ে অপমান ভুলতে আত্মহত্যা করে সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার অলংকারী ইউনিয়নের লালটেক গ্রামের শুকুর আলীর মেয়ে পপি বেগম (১৯)। আত্মহননের পর যথারীতি নিজের পারিবারিক কবরস্থানে দাফনের কথা থাকলেও গ্রাম্য মোড়ল ও স্থানীয় কুসংস্কারের কারণে নিজের জন্মভূমিতে দাফনের সুযোগ পায়নি পপি। ফলে সিলেট নগরীর মানিকপীর টিলায় তার লাশ দাফন করা হয়।
একবিংশ শতাব্দির এ যুগে আত্মহননকারী দাফনের পর ভুত হয়ে স্থানীয়দের জ্বালাতন করবে এ বিশ্বাসে পপির লাশ স্থানীয় ভাবে দাফন করা সম্ভব হয়নি এমনটাই পুরো এলাকা ঘুরে জানা গেছে। পুরো গ্রামবাসী এ ব্যাপারে অবগত ঠিকই কিন্তু মুখ খুলতে সম্পূর্ণ নারাজ। এমনকি নিহত পপির পরিবারও।
সরেজমিনে লালটেক এলাকা ঘুরে জানা যায়, আজ থেকে ২০ বছর আগে অত্র গ্রামের জনৈক জয়বান বিবি (৭০) এর পুত্র ঠিক অনুরূপ ভাবে আত্মহত্যা করলে তার লাশও এ গ্রামে দাফন না করে, পরিবারের লোকজন সিলেটের মানিকপীর টিলায় তার লাশ দাফন করা হয় বলে জানান জয়বান বিবি। তিনি বলেন, আত্মহত্যাকারী মরার পর ভুত হয়ে স্থানীয়দের ক্ষতি করতে পারে এমন ভয়ে আমার ছেলের লাশ গ্রামে দাফন করা সম্ভব হয়নি।
আত্মহননকারী পপির ছোট বোন, তাহির আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী রিপা বেগম জানান, আত্মহত্যার পর পোস্টমর্টেমের মাধ্যমে আমার বোনের লাশ পরিবারের লোকজন মানিক পীর টিলায় দাফন করেন। গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে পপির লাশ কেন দাফন করা হয়নি এ প্রশ্নের জবাবে রিপা হিমশিম খায়। তবে জানায়, দাফনের পর আত্মহননকারী ভুত হয়ে স্থানীয়দের জ্বালাতন করবে এমন ভয়ে গ্রামে তার লাশ দাফন করা হয়নি। এ ব্যাপারে স্থানীয় মুরুব্বিয়ানদের ভূমিকা নিয়ে রিপা কোন উত্তর দেয়নি।
অন্যদিকে, পপির বড় ভাই মনোয়ার হোসেন জানান, দাফন কাপনের টাকা না থাকায় পারিবারিক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই তার বোনকে সিলেটের মানিকপীর টিলায় দাফন করা হয়।
স্থানীয় ইউপি সদস্য আলতাব আলী বলেন, লোকমুখে পপির আত্মহত্যার খবর পেয়েছি। তবে গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে কেন পপির লাশ দাফন করা সম্ভব হয়নি এ ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না। বিস্তারিত স্থানীয় মুরব্বীয়ানগণ অবগত রয়েছেন বলে তিনি জানান।
এ ব্যাপারে বিশ্বনাথ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বর্ণালী পাল বলেন, এটি অত্যান্ত দুঃখজনক। বিষয়টি আজকে আমি শুনেছি। তবে নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে আমাদেরকে এখনো জানানো হয়নি। যদি দাফনের পূর্বে জানানো হতো তাহলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় প্রদক্ষেপ গ্রহন করা যেত। তবুও থানার অফিসার ইন-চার্জ’কে আমি বলেছি, ওই পরিবারকে সার্বিক সহযোগিতা করার জন্য।
উল্লেখ্য, পপি বেগম (১৯) গত ৯ অক্টোবর দিবাগত রাতে তার বোনের বাড়ি তেতলী চেরাগী গ্রামে গণধর্ষণের শিকার হয়। পরদিন সকালে সে বোনের বাড়ি থেকে নিজ বাড়িতে ফিরে গলায় ওড়না পেচিয়ে আত্মহত্যা করে। তাকে দাফনের ২দিন পর তার ব্যবহৃত ভ্যানেটি ব্যাগে নিজ হাতে লেখা একটি চিরকুট (সুইসাইড নোট) পায় পরিবার। ওই চিরকুটে পপি উল্লেখ করে ৯অক্টোবর দিবাগত রাতে বোনের বাড়িতে অবস্থানকালে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে সে ঘরের বাহিরে যায়। তখন পূর্ব থেকে উৎপেতে থাকা বারিক ও জাহেদ তার (পপির) মুখ চেপে ধরে তাকে জোরপূর্বক উঠিয়ে নিয়ে যায় বাড়ির পাশ্ববর্তী জঙ্গলে। তখন তাদের পায়ে ধরে কান্না কাটি করতে থাকলে বারিক-জাহেদ ও তাদের সহযোগীরা মারধর করে পপিকে পাশবিক নির্যাতন করে। নির্যাতনের পর পপিকে বোনের বাড়িতে (যেখান থেকে উঠিয়ে নেওয়া হয়, সেই স্থানে) ফেলে রেখে যায় জাহাঙ্গীর। আর গণধর্ষণের লজ্জা সইতে না পেরে সে আত্মহত্যা করে। এঘটনায় ৪জনকে আসামী করে গত সোমবার রাতে বিশ্বনাথ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন নিহতের পিতা শুকুর আলী। মামলা নং-৫। মামলা দায়েরের পর ওই রাতেই নিহতের ভগ্নিপতি ও তেতলী চেরাগী গ্রামের মৃত আব্দুল মন্নানের পুত্র ফয়জুল ইসলাকে গ্রেফতার করে থানা পুলিশ। পরদিন মঙ্গলবার রাতে মামলার অপর আসামী একই গ্রামের মৃত মতছির আলীর ছেলে জাহেদ (২২)’কে এবং গত বৃহস্পতিবার রাতে মামলার প্রধান আসামী জাহাঙ্গীর আলম (৩৫)’কে গ্রেফতার করে র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব-৯)। তবে মামলার অপর আসামী তেতলী চেরাগী গ্রামের আব্দুল মনাফের ছেলে বারিক মিয়া (৩৭) এখনো পলাতক রয়েছে।