AM-ACCOUNTANCY-SERVICES-BBB

করোনা ব্যবস্থাপনায় যে সংশোধনীগুলো জরুরী

বিশ্বনাথ নিউজ ২৪ ডট কম :: জুন - ১৬ - ২০২০ | ১০: ০৮ অপরাহ্ণ

ডাঃ মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম :: নভেল করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী হানা দিয়ে কভিড ১৯ নামক ভয়ানক মহামারী রোগ সৃষ্টি করে মানব সভ্যতাকে তছনছ করে ফেলেছে। মানুষের জীবনযাত্রা, অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য সব বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। ধ্বংসযজ্ঞ এখনো নির্বিঘ্নে চলমান। তার প্রতিকারে মানুষের প্রচেষ্টা, জ্ঞান, বিজ্ঞান, অর্থ, সামর্থ্য এখনো পর্যন্ত ব্যর্থ। করোনার বিপরীতে এখনো পর্যন্ত মানুষ কার্যতঃ অসহায়।

করোনা মহামারীর প্রভাব চীন, ইটালী, জার্মানী, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণে আসতেছে। কোন কোন দেশে অনেকটা নিয়ন্ত্রিত। বাংলাদেশে করোনার আগমন দেরীতে হয়েছে। ধীরে ধীরে পুরো দেশে এর কমিউনিটি বিস্তার লাভ করেছে। বর্তমানে আমাদের দেশে চলছে করোনার ভরা যৌবন। যদিও সরকার আক্রান্তের মাত্রাভেদে দেশকে রেড, ইয়েলো ও গ্রীণ জোনে ভাগ করেছে, কার্যত করোনামুক্ত কোন এলাকা নেই।

করোনা ব্যবস্থাপনায় শুরু থেকে বিভিন্ন ধরণের কৌশল পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছে। অনেক কৌশল পরবর্তীতে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। Trial and error পদ্ধতিতে যাচাই-বাছাই করে এই মুহূর্তে যে ব্যবস্থাপনা চলছে তার বিভিন্ন ফাঁক ফোকর নিয়ে আমি আলোকপাত করছি। বর্তমান কভিড ব্যবস্থাপনার ধাপগুলো হচ্ছে-

  • লকডাউন
  • সনাক্তকরণ
  • আইসোলেশন
  • সাপোর্টিভ কেয়ার
  • ক্রিটিক্যাল কেয়ার
  • লাশ দাফন/সৎকার

১. লকডাউন : এই প্রক্রিয়ার শুরু ও বাস্তবায়নে সরকারের কৌশলে যথেষ্ট ভুল ছিল। বাঙ্গালী চরিত্র অনুধাবন করেও সরকার লকডাউন বাস্তবায়নে কঠোর হয়নি। বিভিন্ন মহল থেকে সীমিত সময়ের জন্য কারফিউ এর দাবী উঠলেও তা আমলে নেওয়া হয়নি। উপরন্তু সরকারের আশকারা পেয়ে গার্মেন্টস মালিকদের দায়সারা আচরণে কভিড পরিস্থিতি আরো জটিল হয়েছে। বোদ্ধাদের মতে এখনো লকডাউনের প্রয়োজন রয়েছে। পুরো জুন মাস কঠোর লকডাউন তথা কারফিউ বাস্তবায়ন করে কভিড নিয়ন্ত্রণে সরকার লাগাম ধরতে পারেন।

২. ডিটেকশন : সরকার শুরু থেকে কভিড ডিটেকশনে ‘আইইডিসিআর’ এর একচ্ছত্র কর্তৃত্ব দিয়ে ভুল করেছেন। তারা কভিড ডিটেকশনে খুবই ধীর গতিতে এগিয়েছেন। রোগ যেখানে চরম দ্রুততার সাথে বিস্তার লাভ করছিলো, উনারা সে তুলনায় অমার্জনীয় শ্লথ গতিতে ল্যাব তৈরী করছিলেন। এখনো কভিড ডিটেকশনে আমরা দারুণভাবে ব্যর্থ বলা যায়। প্রতিদিন যে পরিমাণ স্যাম্পল কালেকশন ও টেষ্ট করার কথা তার সিকি পরিমাণও আমরা করতে পারছি না। টেষ্ট করতে গিয়ে ও রিপোর্ট পেতে এখনো আমাদের ৭-১০ দিন সময় লাগে। রোগি মৃত্যুবরণ করার পরে প্রায়শই রিপোর্ট আসে। এই অবস্থার উত্তরণে- (ক) RT PCR Lab আরো বাড়াতে হবে। এদের স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। (খ) Rapid Detection kit অবিলম্বে শুরু করতে হবে।

৩. আইসোলেশন : এ পর্যায়ে সরকারের প্রচেষ্টা আরো জোরদার করতে হবে, গণসচেতনতা আরো বাড়াতে হবে। ক্ষেত্র বিশেষে অনেক কঠোর হতে হবে। হোম আইসোলেশনকে প্রাধান্য দিতে হবে। তবে হাসপাতালগুলোতে আইসোলেশন ক‌্যাপাসিটি আরো বাড়াতে হবে। সরকারি, বেসরকারি সকল বড় হাসপাতালকে বাধ্যতামুলক কভিড ব্যবস্থাপনায় সম্পৃক্ত করতে হবে। তবে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হবে ফ্রন্টলাইনার কভিড যোদ্ধা তথা ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের বিষয়ে। তাদের কোয়ারেনটাইন ও আইসোলেশনে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করতে হবে।

৪. সাপোর্টিভ কেয়ার : এ বিষয়ে সরকারের প্রচেষ্টা আরো বাড়াতে হবে। মৃদু ও মাঝারি মাত্রায় আক্রান্ত রোগিদের নিজের বাসায় আইসোলেশনে থেকে টেলিমেডিসিন পদ্ধতিতে সাপোর্টিভ চিকিৎসা গ্রহন করতে এবং হাসপাতালে ভিড় না করতে প্রচারণা আরো বাড়াতে হবে। মৃদু ও মাঝারি মাত্রার রোগে ‘ট্রিটমেন্ট প্রটোকল’ কী তা টেলিভিশন ও সোস্যাল মিডিয়ায় সরকারি উদ্যোগে ব্যাপক প্রচার করতে হবে। তাহলে মিডিয়ায় প্রচারিত এ সংক্রান্ত নানাবিধ অপচিকিৎসার কুপ্রভাব কমবে।

৫. ক্রিটিক্যাল কেয়ার : ক্রিটিক্যাল কেয়ার সার্ভিসের জন্য সারাদেশে দ্রুত আরো আইসিইউ বাড়াতে হবে। সবচেয়ে জরুরী- দ্রুততার সাথে হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণ সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল‌্যান্ট, অক্সিজেন সিলিন্ডারঅক্সিজেন থেরাপি সামগ্রী নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি ক্রিটিক‌্যাল কেয়ার জনবল (ডাক্তার, নার্স ও টেকনিশিয়ান) বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম নিতে হবে।

৬. লাশ দাফন/সৎকার : কবিড রোগি মারা গেলে ইচ্ছুক স্বজনদের তত্ত্বাবধানে লাশ দাফন বা সৎকারের অনুমতি দিতে হবে। এখন এ বিষয়ে ধারণা পরিষ্কার যে লাশ থেকে করোনা সংক্রমণ হয় না। সরকার শুধু বেওয়ারিশ লাশ দাফন করবে।

কোভিড যুদ্ধে জয়লাভের শর্ত :

চলমান কভিড যুদ্ধে জয়লাভের জন্য চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের আস্থায় আনতে হবে, তাদের কর্মস্পৃহা বাড়ানোর জন্য সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিতে হবে। এজন্য জরুরী ভিত্তিতে নিম্নের উদ্যোগগুলো নিতে হবে-

১. বিভাগীয় শহরে কভিড আক্রান্ত চিকিৎসক ও নার্সদের চিকিৎসায় সর্বোত্তম সুবিধা সম্বলিত ডেডিকেটেড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা। কারণ ফ্রন্টলাইনাররা নিজ চিকিৎসার চিন্তায় টেনশনে থাকলে তারা মানুষ বাঁচানোর লড়াইয়ে কতটুকু ভুমিকা রাখবে বলুন।

২.অন‌্যান‌্য স্থানে উপযুক্ত সংখ্যক বিছানা (আইসিইউ’সহ) চিকিৎসক ও নার্সদের জন্য নির্ধারিত করতে হবে।

৩. সরকারি-বেসরকারি সকল চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য উপযুক্ত সম্মান ও সম্মানী নিশ্চিত করতে হবে।

সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। প্রাণহানির পরিমান বেড়ে যাচ্ছে। প্রাণঘাতী করোনা থেকে জনগণকে বাঁচানোর জন্য কোভিড ব্যবস্থাপনার সাথে সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষ আশা করি উল্লিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিবেন।

লেখক: বিশিষ্ট চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।

আরো সংবাদ