Search
Close this search box.

ভুয়া প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি ও কলেজ সরকারিকরণে অসঙ্গতি : দায় কার?

মো. শরীফ উদ্দিন :: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা গত ২৩ অক্টোবর  নতুন করে ২৭৩০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হিসেবে ঘোষণা করেন। এত বিপুল পরিমাণ প্রতিষ্ঠান ইতিপূর্বে কোনো সরকারই একসাথে এমপিওভুক্ত করতে পারেনি। সে জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। তাছাড়া প্রতিটি উপজেলায় একটি করে স্কুল ও কলেজ সরকারিকরণের দ্বারা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। বর্তমানে ২৭৩০টি প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন প্রক্রিয়া শতভাগ দলীয় প্রভাবমুক্ত থাকায় মাননীয়  প্রধানমন্ত্রীকে আবারো অভিনন্দন জানাচ্ছি। কিন্তু এতোকিছুর পরেও কারো কারো অবহেলার কারণে সরকার আজ সমালোচনার মুখে! দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এ দীর্ঘ সময়েও কাজ নির্ভুলভাবে শেষ করতে না পারায় বিভিন্ন মহলে সৃষ্টি হয়েছে চাপা ক্ষোভ।
অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান, ভাড়া বাড়িতে পরিচালিত, শিক্ষার্থী নেই, পাস নেই, স্কুলঘর নেই এমনকি সরকারি হওয়া প্রতিষ্ঠানও এমপিওভুক্তির তালিকায় রয়েছে। এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান আবারো এমপিওভুক্তি পেয়েছে এবং যুদ্ধাপরাধ মামলার আসামির নামে প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তিতে স্থান পেয়েছে এরকম ঘটনাও আছে।
নীতিমালা অনুযায়ী চারটি শর্ত পূরণকারী প্রতিষ্ঠানকে এমপিও দেয়া হয়েছে।
১. প্রতিষ্ঠানের বয়স বা স্বীকৃতির মেয়াদ
২. শিক্ষার্থীর সংখ্যা
৩. পরীক্ষার্থীর সংখ্যা এবং
৪. পাশের হার
প্রতিটি পয়েন্টে ২৫ করে মোট নম্বর ১০০।
২০১৮ সালের আগস্টে আবেদন করে ৯৬১৫টি প্রতিষ্ঠান। এরমধ্যে ২৭৩০টি যোগ্য প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত ঘোষণা করা হয়।
সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার বুরাইয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আফজাল হোসেন জানান, এ প্রতিষ্ঠানটির কলেজ শাখা শতভাগ শর্ত পূরণ করেও এবার এমপিওভুক্তিতে স্থান পায়নি। অথচ পঞ্চগড়ের ভোদা উপজেলার ঝলইশাল শিরি ইউনিয়নের নতুনহাট টেকনিকেল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজ  নামের প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্তির খবর শুনে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। আবার সব শর্ত পূরণ করেও এমপিও পেলনা রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আড়ানী চকরপাড়া দাখিল মাদ্রাসা।
হবিগঞ্জ সদর উপজেলায় অবস্থিত কবির কলেজের অধ্যক্ষ জালালউদ্দিন শাওন জানিয়েছেন, এ কলেজটি ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত  হয় এবং ২০০৭ সাল থেকে এর একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়। প্রতি বছর তিন থেকে চারশো শিক্ষার্থী ভর্তি হলেও এমপিওভুক্তিতে স্থান পায়নি পুরনো এ প্রতিষ্ঠানটি। এদিকে হবিগঞ্জ সদর উপজেলায় জহুর চাঁন বিবি মহিলা কলেজ নামে যে কলেজটি স্থান পেয়েছে আসলে এর অবস্থান হবিগঞ্জ সদর উপজেলায় নয় বর্তমান শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলায়। এ হিসেবে হবিগঞ্জ সদরে একাদশ/দ্বাদশ পর্যায়ের কোনো প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তই হয়নি। আবার কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী উপজেলার সদর ইউনিয়নের এক দেড় কিলোমিটারের মধ্যেই এমপিওভুক্ত হয়েছে চারটি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
যশোরের অভয়নগর উপজেলার এমপিওভুক্ত রাজ টেক্সটাইল মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি এবারো নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় হিসেবে এমপিওভুক্ত হয়েছে।
সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার আসামি আলহাজ্ব শামছুল আলম ঝুনু মিয়ার নামে নামকরণকৃত ঝুনু মিয়া হাই স্কুল এমপিওভুক্তিতে স্থান পেয়েছে। পঞ্চগড় সদর উপজেলার চাকলাহাট ইউনিয়নের বাসিন্দা স্বাধীনতা যুদ্ধ বিরোধী শান্তি কমিটির সদস্য খামির উদ্দিন প্রধানের নামে প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসার আলিম স্তর এমপিওভুক্তিতে স্থান পেয়েছে। বিষয়টি শুধু আশ্চর্যজনকই নয়, রীতিমতো ভয়ংকরও বটে! এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কে কী জানবে? এমপিও দেওয়ার আগে নামগুলো কি বদলানো যেতনা? কর্মকর্তাদের কাজ কি শুধু অনলাইনে আবেদন নেয়া আর তথ্য যাচাই বাচাই না করেই এমপিও দেয়া?
হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার শাহজালাল সরকারি কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অলক চক্রবর্তী জানান, সম্ভবত ২০১১ সালের দিকে তাদের কলেজের ডিগ্রি স্তর এমপিওভুক্তির জন্য  আবেদন করা হয়। ২০১৮ সালের ১২ আগস্ট ২৭১টি কলেজ সরকারি হিসেবে যে তালিকা প্রকাশ করা হয় তার মধ্যে এটি একটি। নতুন করে তাঁরা কোন আবেদন করেনি। তারপরেও নতুন এমপিওমুক্তির তালিকায় সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটি রয়েছে। কলেজ কর্তৃপক্ষ ব্যাপারটিতে রীতিমতো হতবাক!
এখানে একটি বিষয় খুবই স্পষ্ট যে মাঠ পর্যায়ে তারা কোনো প্রতিষ্ঠান যাচাই না করেই শুধুমাত্র নির্ধারিত সফটওয়্যারে আবেদন দেখেই প্রতিষ্ঠান বাচাই করেছে। আবার শিক্ষা বোর্ড থেকেও কোনো তথ্য নেয়া হয়নি। আমি মনে করি এতে কর্মকর্তাদের অবহেলা রয়েছে। কেউ কেউ হয়তো খুব দায়িত্বের সাথে কাজ সম্পাদন করলেও অনেকেই হয়তো সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলবার চেষ্টা করে থাকতে পারেন! তা না হলে যুদ্ধাপরাধীর নামের প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হয় কী করে? এরকম একটি জনগুরুত্বপূর্ণ কাজে গোয়েন্দা রিপোর্টের দরকার ছিল বলেই মনে করি।
আমি মনে করি আবেদন প্রক্রিয়াতে নতুনত্ব আনার দরকার ছিল। প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের আবেদনের সাথে শিক্ষার্থীসহ প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত ছবির সফট কপি যদি সংযুক্ত করা যেত এবং প্রতিটি প্রতিষ্ঠান যাচাইয়ের সময় গোয়েন্দাদের হাতে সফট কপি সরবরাহ করে রিপোর্টের সত্যতা যদি যাচাই করা হতো তাহলে হয়তো এতবড় ভুলের মাশুল দেয়া থেকে জাতি রক্ষা পেত। যাচাই-বাছাইয়ের কথা বলে এতদিন কী করা হলো সেটাই এখন জাতির প্রশ্ন! ভুয়া এমপিওভুক্তির কারণে যেসব প্রতিষ্ঠান বাদ পড়লো তাদের ভবিষ্যৎ কী? সংশ্লিষ্টদের উচিৎ অচিরেই এ তালিকা সংশোধন করে বাদ পড়া যোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে নতুন তালিকা তৈরি করা।
কলেজ সরকারিকরণের কাজেও কিছু অসঙ্গতির প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় চার বছর অতিক্রান্ত হলেও এখনো নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে না। এদিকে গত ১২ সেপ্টেম্বরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জনাব সোহরাব হোসেনের সাথে সরকারি কলেজ স্বাধীনতা শিক্ষক সমিতি (সকস্বাশিস) এর ৭ সদস্যের যে সভা অনুষ্ঠিত হয় সেখানে তিনি দ্রুত আত্তীকরণের আশ্বাস প্রদান করেন। তাঁর এ আশ্বাসকে আমরা সাধুবাদ জানাই। তিনি আরো বলেন, নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার সময় যাদের বয়স ৫৯ শেষ হবে তারা নিয়োগ পাবেনা। যদিও ৮আগস্ট ২০১৮ থেকেই সবাই নিয়োগ পাবে। এ বিষয়টি খুবই দুঃখজনক!
আমি সিনিয়র সচিব মহোদয়কে সবিনয়ে বলতে চাই একজন শিক্ষক ২০১৮ সালের ৮আগস্ট থেকে সরকারি হবেন আশায় রয়েছেন। সবাই জেনে গেছেন তাঁর চাকরি সরকারি হয়েছে। এরপর নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে যদি পাঁচ/সাত বছর লাগে এবং এ কাজ শেষ করার অল্প আগে কারো বয়স যদি শেষ হয়ে যায় তাহলে তিনি সরকারি সুযোগ সুবিধা পাবেন না, এটা কি ভাবা যায়! কাজ যদি দ্রুত শেষ হতো তিনিতো সব সুবিধাই পেতেন তাহলে এখন পাবেন না কেন? কর্মকর্তাদের কাজের অবহেলার খেসারত একজন সাধারণ শিক্ষক কেন দিবেন? তাছাড়া সামাজিকভাবে তিনি যে হেয় প্রতিপন্ন হবেন সেটা কি শোভনীয় হবে?
সরকারিকৃত কলেজ শিক্ষক ও কর্মচারী আত্তীকরণ বিধিমালা ২০১৮ এর ৭(৩) ধারায় চাকরি স্থায়ীকরণের বিষয়ে উল্লেখ আছে, “উপবিধি (২) এ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, অস্থায়ীভাবে নিয়োগকৃত কোনো শিক্ষক বা কর্মচারী অবসরোত্তর ছুটি ভোগরত থাকিলে বা অবসর গ্রহণের বয়স উত্তীর্ণ হইলে বা মৃত্যুবরণ করিলে, তাহাকে, ক্ষেত্রমত, অবসরোত্তর ছুটিতে গমনের তারিখ বা অবসর গ্রহণের বয়স উত্তীর্ণের তারিখ বা মৃত্যুবরণের তারিখের অব্যবহিত পূর্ব তারিখে, সন্তোষজনক চাকরি সাপেক্ষে, ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা প্রদান করিয়া চাকরি স্থায়ী করা যাইবে।” যদি চাকরি স্থায়ী করার ক্ষেত্রে এ ধারা কার্যকর করা যায় তাহলে চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রেও এ ধারা যোগ করে ভুক্তভোগী শিক্ষক-কর্মচারি বা তাঁদের পরিবারের সদস্যদের  জীবনে আলো ফোটানো সম্ভব বলে মনে করি।
সদ্য সরকারিকৃত কলেজগুলোতে এখন আবার শিক্ষা ক্যাডার থেকে অধ্যক্ষ নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারটিকেও আমি সাধুবাদ জানাই যদিও ২০১৮ বিধিমালার ১৩(১) ধারায় উল্লেখ রয়েছে, “সরকারিকৃত কোনো কলেজে কোনো বিষয়ের শিক্ষকের স্থানান্তরিত কোনো পদ শূন্য হইলে, উহা সংশ্লিষ্ট কলেজের সংশ্লিষ্ট বিষয়ের তাৎক্ষণিক বা ভাবিষ্যতে পদোন্নতিযোগ্য শিক্ষকগণের মধ্য হইতে পূরণ করিতে হইবে।” অধ্যক্ষ নিয়োগের ক্ষেত্রে বিধিমালার এ ধারার ব্যত্যয় ঘটছে কিনা তাও বিবেচনার বিষয়।
তবে আমার কথা হলো শুধু শিক্ষা ক্যাডার থেকেই সদ্য সরকারিকৃত কলেজে অধ্যক্ষ নিয়োগ দেয়া হবে কিন্তু কলেজগুলো থেকে শিক্ষকদের অধ্যক্ষ পদে নিয়োগের ব্যবস্থা করা হবেনা, তা কি করে হয়! এক্ষেত্রে ২০১৮ বিধিমালার ৮(১) ধারার বাস্তবায়নে কাজ করা জরুরি। ৮(১) এ  বলা হয়েছে, “সরকারিকৃত কলেজের কোনো শিক্ষক, যে পদেই হউক, শিক্ষা ক্যাডারে অন্তর্ভুক্তির উদ্দেশ্যে, উক্ত ক্যাডারের প্রভাষক পদে নিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা সাপেক্ষে, এতদুদ্দেশ্যে প্রণীত বিধি অনুযায়ী, উক্ত ক্যাডারের প্রভাষক পদে নিয়োগ লাভের জন্য কমিশন কর্তৃক গৃহীত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করিতে পারিবেন।”
পরিশেষে দ্রুত ad-hoc নিয়োগ দিয়ে সকল সমস্যার সমাধান করে শিক্ষক কর্মচারীদের স্বার্থ সুরক্ষায় আরো সুবিবেচনার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মাননীয় শিক্ষা মন্ত্রী, মাননীয় শিক্ষা উপমন্ত্রী এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মহোদয়ের সুদৃষ্টি কামনা করি।

লেখক: প্রভাষক, বিশ্বনাথ সরকারি কলেজ
E-mail: sharifcu82@gmail

আরও খবর