AM-ACCOUNTANCY-SERVICES-BBB

শেষ চিঠিতে মায়ের কাছে যা লেখেছিলেন শহীদ সুলেমান

বিশ্বনাথ নিউজ ২৪ ডট কম :: ডিসেম্বর - ১৪ - ২০১৫ | ১: ০৫ অপরাহ্ণ

Biswanat

এমদাদুর রহমান মিলাদ :: ‘‘মা আজকে আপনার সবচেয়ে বড় গৌরব যে, আপনার ছেলে সত্যিকারের দেশ সেবায় সুযোগ পেয়েছে। আপনার ছেলে সত্যিকারের দেশ সেবা করে যদি প্রাণ বিসর্জন দিতে হয় সেটাও ভাল, মা আমার জন্য কোন চিন্তা করবেন না। অদূর ভবিষ্যতে দেখা হবে। আমাদের চুড়ান্ত অর্জনের আর বেশী বাকী নয়।’’

কথাগুলো এভাবেই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে শহীদ সুলমান হোসেন তার মায়ের কাছে প্রেরণ করা চিঠিতে লিখেছিলেন।

’৭১ সালের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বনাথের অনেকেই দেশের জন্য তাদের জীবন উৎসর্গ করেন। এর মধ্যে শক্রর বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে যুদ্ধের ময়দানে শহীন হয়েছে বিশ্বনাথের ৫জন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন শহীদ সুলেমান হোসেন।
১৯৫০ সালের ১লা ফেব্রুয়ারী সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার খাজাঞ্চী ইউনিয়নের ছোটদিঘলী (বর্তমান শহীদ সুলেমান নগর) গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সুলেমান হোসেন। তার পিতার নাম মওহুম মাষ্টার আব্দুল ওহাব ও মাতার নাম মরহুমা খয়রুন নেছা খাতুন। ৪ভাই ও ৪বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন মা-বাবার ২য় সন্তান। সুলেমান বিশ্বনাথের তালিবপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনের পর তার পিতা সিলেট শহরের রসময় উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মাষ্টার আব্দুল ওয়াব দুস্কুতিকারীদের হাতে নির্মম ভাবে খুন হন। এসময় পরিবারে নেমে আসে শোকের ছায় তেমনি তাঁর শিক্ষাজীবনেও দেখা দেয় অন্ধকারের ঘনঘটা। এ অবস্থায় তাঁর মা তাঁর ভাই-বোনদের নিয়ে মামার বাড়ী কুলাইড়া থানার বরমচালে চলে যান। সেখানে সুলেমান বরমচাল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৬ সালে ১ম বিভাগে এস.এস.সি পাস করেন। এরপর তাঁর নিজবাড়ীতে চলে এসে সিলেট শহরের এম.সি কলেজে আই.এস.সি তে ভর্তি হন। ১৯৬৮ সালে কৃতিত্বের সাথে এইচ.এস.সি পাস করে মদন মোহন কলেজে বি.এ (পাস) এ ভর্তি হন। ১৯৭০ সালে বি.এ টেষ্ট পরীক্ষায় তিনি সম্মিলিত বিভাগে মেধা তালিকায় ১ম স্থান লাভ করেন। ঐ সময় (মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে) পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে লিখিত পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হওয়ার পরও মৌখিক পরীক্ষায় তাঁর বক্তব্য ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ৬দফার অনুকুলে যাওয়ায় বিমান বাহিনীতে তাকে রিক্রুট করা হয়নি। অতঃপর সুলেমান দক্ষিণ সুরমা মকন উচ্চ বিদ্যালয়ে কিছু দিন শিক্ষকতা করেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর গ্রামে গঞ্জে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ব্যক্তিদের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় সামরিক প্রশিক্ষণ। শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধ। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রয়োজনে চূড়ান্ত পরীক্ষাকে উপেক্ষা করতে দ্বিধা করেননি তেজোদ্বীপ্ত মেধাবী ছাত্র সুলোমান। তাইতো তিনি বি.এ পরীক্ষায় অংশগ্রহন না করেই সহপাঠিদের নিয়ে মদন মোহন কলেজের পার্শ্বে তাঁর খালার বাসায় (যে খানের তিনি অবস্থান করতেন) নিজের আঙ্গুল কেটে দেয়ালে ‘‘জয় বাংলা’’ লিখে যুদ্ধে অংশগ্রহণের অঙ্গিকার নেন এবং সবাইকে নিয়ে ভারতের দেরাদুরানে ট্রেনিং-এ চরে যান। এসময় তার বড় ভাই লোকমান হোসেন ও চাচাতো ভাই গোলাম মস্তফাও তাঁর সাথে যোদ্ধে গিয়েছিলেন।
সুলেমানের নৈপূণ্য ও যোদ্ধের কলাকৌশলে মুগ্ধ হয়ে ভারত সরকার তাকে স্থায়ীভাবে চাকুরী নিয়ে ভারতে বসবাস করার প্রস্তাব দিলে তিনি তা প্রত্যাখান করেন এবং ট্রেনিং শেষ হওয়ার পর মায়ের কাছে একটি পত্র লিখে মাতৃভূমির জন্য সশ্রস্ত্র মুক্তিযোদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন। মায়ের কাছে তাঁর এই চিঠিটাই ছিলো শেষ চিঠি। এ চিঠিখানা মদন মোহন কলেজের লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত রয়েছে। সুলেমান তাঁর মুক্তি বাহিনী নিয়ে সিলেটর প্রত্যন্ত অঞ্চলে বীরত্বের সাথে যোদ্ধ করেন। তার সাহসীকতার কথা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল পর্যন্ত জানত। তিনি ৪নং সেক্টর কমান্ডার মেজর সি.আর দত্তের অধীনে কাজ করলেও তীক্ষè উপস্থিত বুদ্ধির জন্য মিত্র বাহিনী সিলেট অঞ্চল মুক্ত করার লক্ষে গঠিত কমান্ডো গ্র“পে তাকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। যোদ্ধের শেষের দিকে যখন বিভিন্ন অঞ্চল ধীরে ধীরে শত্র“মুক্ত হচ্ছে তখনই ১৯৭১ সালে ১০ ডিসেম্বর অপরাহ্নে ১২-১৩ জনকে সাথে নিয়ে সুলেমান হেলিকাপ্টার সিলেট শহরের নিকটবর্তী দুবড়ী হাওর (বর্তমান উপশহর) এলাকায় পৌছলে পাকসেনারা তাদের ঘেরাও করে ফেলে। এসময় সুলেমান ও সহযোদ্ধারা তখন অনবতর গোলাবর্ষণ করে পাক সেনাদের ছিন্নভিন্ন করে দেন। পরে দুবড়ী হাওর থেকে সোনারপাড়া হয়ে হাদার পাড়ায় যোদ্ধের ম্যাপ নিয়ে যাওয়ার সময় পাক সেনারা তাকে ঘেরোও করে ফেলে। তখন সুলেমান জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবিরত গুলিবর্ষন করতে থাকেন। এক পর্যায়ে তার গোলাবারুদ শেষ হয়ে গেলে পাক সেনারা তার ডান পায়ে গুলি করে সোনারপাড়ায় একটি ঘরে নিয়ে পাশবিক নির্যাতন করতে থাকে এবং ১৪ ডিসেম্বর দুপুরে প্রকাশ্যে সুলেমানকে হত্যা করে লাশ নিয়ে পালিয়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শী এক বৃদ্ধা মহিলার কাছ থেকে খবর পেয়ে তার বড় ভাই সহযোদ্ধা লোকমান হোসেনসহ অন্যান্য সহযোদ্ধারা অনেক খুজাখুজি করেন। কিন্ত দূর্ভাগ্য জনক হলেও সত্য যে এই শহীদ মুক্তিযুদ্ধার লাশ তার স্বজনরা কিংবা দেশবাসী পাননি। শহীদ সুলেমান হোসেন একটি স্বাধীন ও মুক্ত দেশের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিয়ে ধন্য করেছেন স্বদেশ ও স্বজাতিকে। শহীদ সুলেমান হোসেন নিজে পিতার আদর্শে গড়ে উঠার চেষ্টা করেন। তিনি ছিলেন ধার্মিক ও পরোপকারে নিবেদিত প্রাণ। যুদ্ধের কঠিন মুহুর্তেও তিনি নামাজ পড়েছিলেন। তার মা শহীদ জননী খয়রুন নেছা খাতুন ২০১১ সালের ফেব্র“য়ারী মাসে ইন্তেকাল করেছেন। বড় ভাই সহযোদ্ধা লোকমান হোসেন বর্তমানে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন তিনি যুক্তিযোদ্ধা সংসদ যুক্তরাজ্য শাখার কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
মুক্তিযোদ্ধে জীবন উৎসর্গকারী শহীদ সুলেমান হুসেনের জন্মভূমি ছোট দিঘলী গ্রামের জনগন গ্রামের নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘শহীদ সুলেমান নগর’। বর্তমানে গ্রামটি সরকারী গেজেডের একটি গ্রাম। এছাড়া সিলেটের প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের জিন্নাহ হলের নাম পরিবর্তন করে শহীদ সুলেমানের নামে নাম করন করা হয়।

আরো সংবাদ