Search
Close this search box.

চাউলধনী হাওরের জমি ফেটে চৌচির : হুমকির মুখে কৃষি

এমদাদুর রহমান মিলাদ :: মাত্র ১৩ লাখ ৫২ হাজার টাকার ইজারার কারণে সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার সর্ববৃহৎ হাওর ‘চাউলধনী’তে হুমকির মুখে পড়েছে প্রায় ১০ কোটি টাকা মূল্যের বোরো ধান উৎপাদন। মাছ ধরার জন্য ইজারাদাররা হাওরের পানি শুকিয়ে ফেরার কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে চাউলধনী হাওর চার পাড়ের বাসিন্দারা। আর পানির অভাবে হাওরের জমিগুলো ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। ইজারাদাররা সরকারের দেয়া নির্দিস্ট শর্তগুলো ভঙ্গ করে নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী রাজত্ব কায়েম করার ফলে এলাকায় চড়ম উত্তেজনা বিরাজ করছে।

দশঘর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমটেডের নামে ইজারা থাকলেও সহযোগী আরও ১২ প্রভাবশালীকে সঙ্গে নিয়ে চাউলধনী হাওর গিলে খাচ্ছেন মূল ইজারাদার চৈতননগরের বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম। আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শন করে হাওর এলাকায় মৎস্যজীবিদের নাম ব্যবহার করে প্রভাব বিস্তারকারী অমৎস্যজীবিদের প্রভাবে নিজেদের জমিতে থাকা পুকুরগুলোতে মাছ শিকার করতে পারছেন না এলাকাবাসী। এমনকি এলাকার গরু-ছাগলগুলোকে গোসল ও পানি পান করানোর জন্য এলাকাবাসীদের জমিতে করা পুকুরেও জোরপূর্বকভাবে শুকিয়ে নিয়েছে ইজারাদাররা। তাছাড়া এলাকার কেউ হাওরে বা নিজের জমিতেও থাকা পুকুরে মাছ শিকার করলে ইজারাদারদের ক্যাডার বাহিনী এলাকাবাসীর বাড়িতে বাড়িতে প্রবেশ করে জোরপূর্বকভাবে মাছ ধরার দ্রব্যগুলো ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। হাওরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা হাঁসের খামারগুলোও ওই গুটি কয়েক অমৎস্যজীবির অপকর্মের কারণে একে একে বন্ধ হয়ে পড়ছে।

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, চাউলধনী হাওরের গত বছরই প্রায় ৮শত হেক্টর জমিতে (দৌলতপুর ইউনিয়নে ৫৫০ হেক্টর ও দশঘর ইউনিয়নে ২৫০ হেক্টর) বোরো ধানের চাষাবাদ হয়েছে। আর ওই ৮শত হেক্টর জমি থেকে প্রায় ৩ হাজার ৭৮৪ মেট্টিক টন ধান উৎপান হয়েছে। যার আনুমানিক বাজার মূল্য (সরকারি হিসেবে কেজি ২৬ টাকা ধরে) প্রায় ৯ কোটি ৮৩ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। তার মানে পানি অভাবে কৃষকরা যদি এবছর বোরো ধানের চাষ করতে না পারেন তা হলে এক চরম ক্ষতির শিকার হবে বাংলাদেশের কৃষি। আর ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া হাওর পাড়ের কৃষকদেরকে পোহাতে হবে চরম দূর্ভোগ।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রমজান আলী বলেন, বোরো ধানের উৎপাদনের জন্য যে পরিমাণ পানি হাওরে থাকার কথা বর্তমানে সেখানে তা নেই। ফলে বোরো ধানের উৎপাদন বাঁধাগ্রস্থ হবেই।

সরেজমিনে চাউলধনীর হাওর ঘুরে দেখা গেছে, বোরো চাষাবাদ শুরুর আগেই বিস্তীর্ণ হাওরের নিম্নাঞ্চলও শুকিয়ে গেছে। শুকিয়ে গেছে হাওরের ১৬টি বিল, ৩০টি খাল, নালাসহ ছয় শতাধিক পুকুরও। হাওরের অধিকাংশ বীজতলা ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। চাষাবাদের জন্য এলাকাবাসীর তৈরী করা বীজতলাগুলো (আলীতলা) পানির অভাবে রোদে পুড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। সেচের পানির তীব্র সংকঠ থাকার কারণে নিজেদের জমিগুলোতে চাষাবাদ করতে পারছেন না হাওর পাড়ের ধনী-গরীব কৃষক পরিবারগুলো। ফলে পানি সংকটে এবার দুই হাজার বোরো জমি অনাবাদি থাকার আশঙ্কা রয়েছে। আর বোরো উৎপাদন করতে না পারলে তাদের অনেককেই আগামীতে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে হবে। পানির অভাবে ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিগুলোতে থাকা কচুরীপানাগুলোও রোদে পুড়ছে। হাওর পাড়ে থাকা গরীব পরিবারগুলো অতিথে যেভাবে সহযেই হাওর থেকে শিকার করা মাছের মাধ্যমে আমিষের চাহিদা পূরণ করতে পেরেছেন বর্তমানে তা আর পারছেন না। আর হাওরে মাছ শিকার করতে না পারায় বেকার হয়ে পড়েছেন অনেক প্রকৃত মৎস্যজীবিও। যার ফলে চরম দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে হাওর পাড়ের মৎস্যজীবি পরিবারগুলোকে।

হাওর পাড়ের পাড়ুয়া গ্রামের বাবুল মিয়া, প্রবাসী শফিকুর রহমান, মিরগাঁও গ্রামের আবুল কালাম, হাসনাজি গ্রামের আশ্রব আলী, চৈতননগর গ্রামের নজির উদ্দিন, দৌলতপুর গ্রামের রুহেল মিয়া কালু, পূর্বপাড়া নোয়াগাঁও গ্রামের হাফিজ আরব খান বলেন, স্থানীয় প্রশাসন তথা সরকারকে ওই সমস্যার সমাধানের জন্য দ্রুত উদ্যোগী হতে হবে। আর এজন্য কৃষকদেরকে চর ক্ষতির মুখে দাঁড় করানো ইজারাদারদের বর্তমান ইজারা বাতিল করে হাওরে থাকা সরকারি ও ব্যক্তি মালিকাধীন ভূমি চিহ্নিত করতে হবে। এতে এলাকার গরীব মানুষেরা নিজেদের আমিষের চাহিদা পূরণের জন্য ও গরীব মৎস্যজীবিরা নিজেদের জীবিকা নির্বাহের জন্য নিজেদের ব্যক্তি মালিকানাধীন জলাশয় থেকে মাছ শিকার ও বিক্রয় করতে পারবেন। সর্বপুরি সরকারের শর্ত ভঙ্গ করে হাওরের পানি শুকানো ইজারাদারদের কাছ থেকে কৃষকদের ক্ষতিপূরণ আদায় করে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহন করতে হবে দ্রুত।

ইজারাদার সংগঠনের সহসভাপতি জুনাব আলী বলেন, সমিতি ইজারার শর্তানুযায়ী মৎস্যজীবী সমিতি হাওরে মাছ ধরছে।

বিশ্বনাথ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মুহিবুর রহমান বলেন, গুটি কয়েক প্রভাবশালীর কারণে চাউলধনী পাড়ের কৃষি আজ হুমকির মুখে পড়েছে। কৃষি ও কৃষকদের বাঁচানোর জন্য হাওরের ইজারা প্রদানের সময় দেওয়া সরকারের শর্ত ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন জরুরী। তাছাড়া কৃষক ও এলাকার গরীব মৎস্যজীবিদের স্বার্থে হাওর ও ব্যক্তি মালিকানাধীন জমির সীমানা নির্ধারণ করা জরুরী। তাছাড়া বৃহৎ স্বার্থে হাওরের ইজারা বাতিল করে সবার জন্য উন্মোক্ত করে দিলে মানুষ আরো বেশিই উপকৃত হবেন।

বিশ্বনাথ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম নুনু মিয়া বলেন, কোন অবস্থায় বিশ্বনাথের কৃষি ও কৃষকের ক্ষতি হতে দেওয়া যাবে না। কৃষি ক্ষতিগ্রস্থ হয় যে যারাই জড়িত থাকবে তাদের বিরুদ্ধে যথাযত ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

আরও খবর