সাইফুল ইসলাম বেগ :: অধ্যাত্মিক রাজধানী সিলেটের পরতে পরতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পীর-আউলিয়া, দরবেশের মাজার ও নানা স্মৃতি চিহ্ন। এ অঞ্চলে ধর্ম প্রচারকালে বিভিন্ন এলাকায় তাদের সাময়িক বিশ্রামের স্থানও পেয়েছে ‘মোকাম’র খ্যাতি। অস্থায়ী বিশ্রামের এসব জায়গাকে স্মরণীয় করে রাখতে, ভক্তরা তা সংরক্ষণ করেছেন প্রার্থনার স্থান হিসেবে। তেমনি এক স্থানের নাম ‘পাঁচ পীরের মোকাম’। সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলার সাদীপুর ইউনিয়নের লামা গাভুর টিকি গ্রামে ঐতিহাসিক এ মোকামের অবস্থান। মোকামের অপার রহস্য একাধিক প্রচীন হিজল গাছ। গোড়া থেকে শাখা-প্রশাখায় অগুণতি বড় বড় ছিদ্র নিয়ে অর্শ্চযজনক ভাবে যুুগের পর যুগ, কালের স্বাক্ষী হিসেবে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে গাছগুলো।
পাঁচ পীরের মোকামে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের উত্তর-পশ্চিম দিকে প্রায় ১শ ৪২ শতক জায়গা নিয়ে মোকামের অবস্থান। উঁচু জায়গায় রয়েছে একটি মাজার রকম স্থাপনা। এটি মাজারের জনৈক মহিলা খাদেমের কবর বলে জানা যায়। এর পাশেই বড় গাছের গোড়ায় দেখা যায়, প্লেট ভর্তি রাখা গভীর দুধ। তার ডান পাশে পাঁচ পীরের পরিত্যাক্ত দীঘি। আছে ইবাদতের পাকা ঘর। বাম পাশেই সমতল জায়গায় দৃষ্ঠি নন্দন সবুজ হিজল বাগান। এখানে রয়েছে প্রায় একই রকমের ছোট বড় ১৪টি প্রাচীন গাছ। প্রত্যেকটা গাছেরই গোড়া থেকে শাখা-প্রশাখায় অসংখ্য বড় বড় ছিদ্র। কোন গাছের পুরো গোড়ায়ই ছিদ্র। চালের উপর দাঁড়িয়ে আছে গাছ। কোনটির আছে নামমাত্র শেকড়। কোনটির আবার মধ্যখানে দু’ভাগ। দেখা যায় এপাশ-ওপাশ। তবুও যুগের পর যুগ ‘রহস্যজনক’ ভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে এ হিজল বাগান। কেবল হিজলই নয় মোকামের অন্যান্য গাছ গুলোও একই রকম ছিদ্রে ভরপুর।
গাছের গোড়ার ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করে মগডাল দিয়ে অনায়াসে বেরিয়ে যেতে পারবে যে কোন সরীসৃপ প্রাণী। কথিত আছে হিজল বাগানের গাছে গাছে বড়বড় বিষাক্ত সাপের বিচরণ। ভাগ্য ভালো হলে দেখা মিলে তাদের। তারা ক্ষতি করেনি কারো আজও। মনবাসনা পূরণে, সাপের খাবার হিসেবে ভক্তরা গাছের গোড়ায় ও পুকুরে ছিটিয়ে দেন গাভীর দুধ। একটি নির্দিষ্ট গাছ তলায় প্রতিদিন রাখা হয় প্লেট ভর্তি দুধও।
স্থানীয়রা জানান, সিলেটের সুফি সম্রাট হযরত শাহ জালালের সফর সঙ্গী হযরত শাহ গরীব বা শাহ গাবরু (রহ.) এর আস্তানা ছিল এটি। একটি উচু টিবির উপর সাধনা করতেন তিনি। তার নামানুসারেই এই এলাকার নামকরণ ‘গাভুর টিকি’ করা হয়। এখানে বহুকাল পূর্বে ইসলাম প্রচার করতে আসা ৫ জন দরবেশের একটি কাফেলা সাময়িক আস্তানা গড়েন। একটি গাছের মাথায় লাল সামিয়ানা ঝুলিয়ে কিছুদিন অবস্থান করেন তারা। কেউ কেউ বলেন, এরাও ছিলেন হযরত শাহ জালালের সফর সঙ্গী।
তবে, শুরু থেকে সংরক্ষণ না হওয়ায় মোকামের সঠিক ইতিহাস নিয়ে এলাকায় নানা গল্প প্রচলিত আছে। কারো কারো ধারণা, ব্রিটিশ আমলে তারা (পাঁচ পীর) পারস্য থেকে এসেছিলেন। তবে এই পাঁচ পীরের নাম-পরিচয় ও আগমনের তথ্য নিশ্চিত করে বলতে পারেনি কেউ।
গ্রামের মুরব্বি আবদুশ শহীদ ওরফে শাহীদ মিয়া (৭০) বলেন, পূর্ব পুরুষদের কাছ থেকে শুনেছি এখানে পাঁচজন দরবেশ সাময়িক বিশ্রাম নিয়েছিলেন। এরপর থেকেই এটি মোকাম হিসেবে প্রসিদ্ধ। জন্ম থেকে একই রকম দেখছি মোকামের ঐতিহাসিক প্রত্যেকটি হিজল গাছ। আমাদের পূর্ব পুরুষরাও বলেছেন, তারাও অনুরুপ দেখেছেন। অনেকটা শুন্যের উপর দাঁড়িয়ে থাকা মোকামের ছিদ্র বিশিষ্ট হিজল গাছ গুলো এক অপার রহস্য। প্রতিবছর চৈত্র মাসের ১৩ তারিখ এখানে ভক্তরা জড়ো হয়ে পীরদের উদ্দেশ্যে ভক্তি-শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
মোকামের বর্তমান খাদেম মো. গেদু মিয়া (৫০) বলেন, পাঁচ পীরের মোকাম প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্য সমৃদ্ধ। এ মোকামের পুরো ইতিহাস জানা যায়নি। প্রায় ২০-২৫ বছর ধরে আমি দেখাশুনার দায়িত্বে আছি। মোকাম এলাকায় সাপের বিচরণ থাকায় গাভীর দুধই বেশী মানত করনে ভক্তরা। আর হিজল গাছগুলি মূলত এ মোকামের মূল আকর্ষণ।