AM-ACCOUNTANCY-SERVICES-BBB

কিছু কথায় বাসিয়া নদীর কষ্ট প্রকাশ

বিশ্বনাথ নিউজ ২৪ ডট কম :: জুন - ১৪ - ২০১৯ | ৩: ০৩ অপরাহ্ণ

প্রনঞ্জয় বৈদ্য অপু :: আমি একটি নদী। আমার নাম বাসিয়া। সিলেট সদর উপজেলার মাসুকগঞ্জ বাজার নামক স্থানই হচ্ছে আমার উৎপত্তিস্থল। এখানে ‘সুরমা’ নদী থেকে আমার (বাসিয়া নদী) যাত্রা শুরু হয়েছে এবং তা শেষ হয়েছে সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার খাইকা নামক স্থানে ‘কুশিয়ারা’ নদীর সাথে মিলিত হয়ে। উৎপত্তিস্থল মাসুকগঞ্জ বাজারে অতিরিক্ত পলিমাটি ও দখলদারদের কারনে আমার (বাসিয়া) জন্মমুখটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে এখন আমি পরিণত হয়েছি একটি ছোট একটি খালে। অবশ্য আমার সংযোগস্থল খাইকার একই অবস্থা।
এক কালে আমি ছিলাম তীব্র খরস্রোতা একটি নদী। কিন্তু কালের বিবর্তনে আজ ভরাট ও দখল হয়ে আমি (বাসিয়া) ছোট একটি খালে পরিণত হয়েছে, এর সাথে সাথে হারিয়ে ফেলেছে চিরাচরিত নাব্যতাও। একসময় আমার (বাসিয়া) বুকের উপর দিয়ে চলত বড় বড় লঞ্চ, ষ্টিমার, স্পীডবোট, পাল তোলা নৌকা। এখন সেই আমি বাসিয়ার এপাড় থেকে ওপাড়ে পায়ে পায়ে হেঁটে খুব সহজেই পার হতে পারে ছোট একটি শিশুও। তাছাড়া এককালে আমার (বাসিয়া) বুকের উপর দিয়েই গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গা থেকে বাসিয়া নদীতে ছিলো নৌকা চলাচল। তাই নৌ পথে নৌকা যোগে মৌসুমের টাটকা শাক-সবজি আসতো। কিন্তু বর্তমান সময়ে আমি (বাসিয়া) ভরাট হয়ে যাওয়ার কারনে তা আসে না। আমার (বাসিয়া) বুকের পানির মধ্যে ছিলো নানান জাতের মাছের খেলা। কিন্তু দিন দিন আমার (বাসিয়া) আয়তনের পাশাপাশি পানির পরিমাণ কমে যাওয়ার ফলে মাছের আশ্রয়স্থও কমে এসেছে। ফলে কমে যাচ্ছে মাছের পরিমানও।
সিলেট সদর, দক্ষিণ সুরমা, বিশ্বনাথ, জগন্নাথপুর উপজেলা দিয়ে বয়ে যাওয়া ফলে আমার (বাসিয়া) কাছ থেকে সাহায্য পেয়েছে লাখ লাখ মানুষ। কিন্তু আজ আমার (বাসিয়া) উৎপত্তি ও সংযোগ দুই মুখসহ বিরাট অংশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় সেখানে অবৈধ ভাবে স্থাপ্তিত হয়েছে কত স্থাপন। এসব স্থাপনাগুলোর মালিকগণ অনেকটা কৌশলে আস্তে আস্তে আমাকে (বাসিয়া) ঘিলে খাওয়ার জন্য দিন দিন আমার (বাসিয়া) আয়তন কমিয়ে বৃদ্ধি করছেন তাদের স্থাপনার আকার। স্থানীয় প্রশাসনের নাকের ডগায় আমার (বাসিয়া নদী) চরগুলো দখল হয়ে গেলেও তাতে তাদের কিছু যায় আসেনা এমন ভাব করে করে নিরব ভূমিকা পালন করছেন তারা। ফলে দখল প্রক্রিয়া রয়েছে অব্যাহত।
‘এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাওয়ার সময় তার’ কবির লেখা বাক্যটির তাৎপর্য রয়েছে অনেকখানি। কিন্তু আমি (বাসিয়া) আমার যৌবনকাল পেরিয়ে আসার ফলেই আজ হারিয়ে ফেলেছি চিরাচরিত সেই নব্যতা। এখন আমি (বাসিয়া) মৃত প্রায় একটি নদীতে পরিণত হয়েছি। আমার (বাসিয়া নদী) উৎপত্তি ও সংযোগ মুখ দুটি খনন করা হলে আমি ফিরে পেতাম আমার (বাসিয়া) হারিয়ে যাওয়া যৌবন আর নাব্যতা। এতে উপকৃত হতো লাখ লাখ মানুষ জন। সবচেয়ে বেশি উপকৃত হতো বিশ্বনাথ তথা সিলেট সদর, দক্ষিণ সুরমা, জগন্নাথপুর উপজেলার কৃষককূল।
একদিকে আমার (বাসিয়া নদী) চরগুলো ভরাট হচ্ছে আর অন্যদিকে সেই ভরাটকৃত চরগুলো দখল করে সমাজের ভূমিখেকোরা তাতে নির্মাণ করছেন দালান কোঠা ও বড় বড় অট্টালিকা। আর এমনভাবে তারা পর্যায়ক্রমে সেগুলো (দালান ও অট্টলিকা) নির্মাণ করেছেন যে দূর থেকে দেখলে মনে হবে আমি (বাসিয়া) হচ্ছি একটি বিশাল ভবন আর সেই ভবনের ‍চূঁড়ায় উঠার সিঁড়ি হচ্ছে ওই দালানগুলো। লোকমুখে এখনও কথিত রয়েছে- একসময় যারা আমার বুকে ছোট্ট একটি দোকান নিয়ে বসে ছিলেন, তাদের অনেকেই আজ সেই বিশাল বিশাল দালান-অট্টলিকার মালিক হয়েছেন। তার সবে নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন করেছেন ঠিকই, কিন্তু আমার করেছেন সর্বনাশ। আর এর ফলে সবচেয়ে বড় ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে পরিবেশ ও সেই সব ভূমিখেকো চক্রের ভবিষ্যৎ প্রজন্মরা।
এলাকার কিছু প্রভাবশালী মহল ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা প্রথম দিকে আমার (বাসিয়া) চর দখল কিংবা দখলের পর দালান কোঠা নির্মানে কোন বাঁধা কিংবা আপত্তি না করার কারনে দিন দিন দখলের পায়তারা আরো ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। যা বর্তমানেও অব্যাহত রয়েছে। এতে কিছু স্বার্থভোগী মানুষ তাদের নিজেদের স্বার্থ খুব সহজেই হাসিল করে নিচ্ছেন। ওয়ান ইলেভেনের সময় সারা দেশের ন্যায় বিশ্বনাথেও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ্দের কার্যক্রম শুরু হয়। তখন বিশ্বনাথ তথা আশেপাশের উপজেলাগুলোর মানুষজন ভেবেছিলেন এবার হয়তো আমার (বাসিয়া) দুই তীর থেকেও অবৈধ স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ করে পর্যায় ক্রমে পুনঃখনন করা হবে। কিন্তু অদৃশ্য কারণে আমি (বাসিয়া)’সহ উপজেলার প্রধান প্রধান নদী ও খালগুলো রক্ষা পায়নি প্রভাবশালী ওই ভূমি খেকোদের হাত থেকে, বরং হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের কার্যক্রম।
আমি (বাসিয়া নদী) ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে জমিতে পানি সেচ ও নিষ্কাশনে এলাকার কৃষকদেরকে পোহাতে হচ্ছে চরম দূর্ভোগ। এতে করে বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে ফসলাধি উৎপাদন। তাই আগের চেয়ে কয়েকগুন কমে গেছে ধান ও শাক-সবজি উৎপাদন। তাই আমাকে (বাসিয়া নদী) এখনই খনন করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। কারণ এখনই আমাকে খনন করা হলে একদিকে যেমন কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, অন্যদিকে তেমনি বাড়বে নৌ চলাচলের সুযোগ। কারণ আমিই (বাসিয়া) ছিলাম এক সময় জগন্নাথপুর, ছাতক, বিশ্বনাথ, দক্ষিণ সুরমা ও সিলেট সদর (অংশ বিশেষ) উপজেলার মানুষের নৌ-পথে চলাচলের অন্যতম পথ। আমাকে (বাসিয়া নদী) ব্যবহার করেই নৌকা-লঞ্চ যোগে টাটকা শাক-সবজি আমদানী-রপ্তানী, বালু-পাথর-সিমেন্ট আনা-নেওয়া করতে পারবেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এখন আমি (বাসিয়া) ভরাট হয়ে যাওয়ার কারনে তা সম্ভব হয়না। আর নৌ পথে চলাচলে মানুষের খরচের পরিমানও ছিলো কম। তাই নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামও ছিলো অনেকটা সাধারণ মানুষের ক্রয়-ক্ষমতার মধ্যে। কিন্তু বর্তমান সময়ে নৌ-পথ ব্যবহারের সুযোগ সুবিধা না থাকায় চলাচলের ক্ষেত্রে খরচের পরিমান বৃদ্ধি পেয়েছে পূর্বের চেয়ে কয়েকগুন বেশি। এতে বিভিন্ন জিনিসপত্রের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে ব্যবসায়ীরা যেমন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন, তেমনি টাটকা শাক-সবজি খাওয়া থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন শহরাঞ্চলের বাসিন্দারা।
আমার কাছ থেকে এত উপকার পাওয়ার পরও বিশ্বনাথ উপজেলা তথা আশেপাশের উপজেলাগুলোর লোকজন আমাকে ব্যবহার করে থাকেন একটি ডাস্টবিন হিসেবেও। তাইতো বিভিন্ন স্থানে আমার তীরে দেখা যায় ময়লা-আবর্জনার স্তুপ। আমাকে (বাসিয়া) কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠা বাজারগুলোর পাশেই এধরনের দৃশ্যটা দেখা যায় বেশী। এসব ময়লা-আবর্জনা আমার (বাসিয়া) তীরে ফেলার ফলে এগুলো দিন দিন তীর ভরাটের কাজ করে ব্যাপক হারে। অনেক জায়গায় আবার কৌশলেও এসব ময়লা-আবর্জনা ফেলেন ভ‚মিখেকোরা চর দখলের পায়তারায়। অনেক স্থানেই আবার চর দখল করে দালান কোঠা নির্মান করেছেন নদীর উপরে। দালানের নিচের দিকটা রেখেছেন ফাঁকা, যাতে পরবর্তিতে ময়লা-আবর্জনা ও নদীর পলি আটকে বা আটকিয়ে ভরাট হয়ে যায় কিংবা করা যায় এই আশায়।
এক সময় আমার (বাসিয়া নদী) পানির মধ্যে প্রচুর পরিমানে মাছ শিকার করতেন এলাকাগুলোর ছেলে-বুড়ো ও মৎস্যজীবিরা। কিন্তু কালের পরিক্রমায় আমি (বাসিয়া) ভরাটের ফলে তাই কমে গেছে মাছের বিচরণ ক্ষেত্রও। এতে বিভিন্ন স্থানে মাছ শিকারের জন্য বিভিন্ন রকমের জাল এখনও টানানো থাকলেও কেউ ধরতে পাচ্ছেন না মাছ। অথচ এক সময় আমার (বাসিয়া) পানিতেই মাছ শিকার করে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করেছেন বিশ্বনাথ তথা আশেপাশের ৪/৫টি উপজেলার মৎস্যজীবিরা। মাছের বিচরণ ক্ষেত্র আমার মতো অন্যান্য ‘নদী ও খালগুলো’ ভরাট ও দখল হয়ে যাওয়ার ফলে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে বেকারত্ব। বেকারত্ব বাড়ার সাথে সাথে নিন্ম আয়ের এসব মানুষজনও দিন দিন নানা প্রকার অপরাধ কর্মকান্ডের সাথে জড়িত পড়ছে। ফলে সমাজে বৃদ্ধি পাচ্ছে অপরাধ প্রবনতাও।
যেসব উপজেলার মধ্য দিয়ে বয়ে গেছি আমি, সেসব উপজেলার বেশ কয়েকটিতে নিন্ম আয়ের মানুষজন থাকার জন্য নির্মিত হয়েছে কলোনী। আর সেই সব কলোনীর বাসিন্দাদের মধ্যে বেশির ভাগ বাসিন্দাই পাচ্ছেন না বিশুদ্ধ পানি ও স্বাস্থ্য সম্মত পায়খানার ব্যবহারের ব্যবস্থা। ফলে বাধ্যহয়েই এসব কলোনীর মানুষজন আমি (বাসিয়া)’সহ বিভিন্ন নদী-খালের চরে কিংবা উপরে প্রাকৃতিক কাজ সারার জন্য টয়লেট নির্মান করছেন। একদিকে টয়লেটের ময়লা ও অন্যদিকে বিভিন্ন জনের ফেলা ময়লা-আবর্জনার স্তুপ আমি (বাসিয়া)’সহ অন্যান্য নদীগুলোর পানিকে দুষিত করে তুলছে প্রতিনিয়ত। এছাড়া বিশুদ্ধ পানির অভাবে ওই সব কলোনীর বাসিন্দারা আবার বাধ্য হয়ে বিষাক্ত হয়ে উঠা পানিতেই গোসল করছেন, থালাবাসন করছেন পরিস্কার, এমনকি খাওয়ার জন্যও ব্যবহার করছেন। বিষাক্ত পানি দৈনন্দিন কাজে ব্যবহারের ফলে এসব মানুষজন আক্রান্ত হচ্ছেন নানাবিধ রোগে। এমনিতেই তাদের আয়ের পরিমান কম। তার উপর রোগবালাই, এসব গরীব জনসাধারনের জীবনকে আরো দুশ্চিন্তার মধ্যে ফেলে দেয়। এর ফলে অনেকেই নানান অপরাধ কর্মকান্ডের সাথে জড়িত হচ্ছেন নিজেকে কিংবা নিজেদের সন্তানদের চাহিদা মেটানোর জন্য কিংবা বেঁচে থাকার জন্য কিংবা বাঁচিয়ে রাখার জন্যই।
সর্বপুরি আমি (বাসিয়া)’সহ উপজেলা তথা দেশের অন্যান্য নদীগুলো পুনঃখনন ও নদীর তীরে গড়ে উঠা সকল অবৈধ উচ্ছেদ করা না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মরাই সবচেয়ে বড় হুমকির সম্মুখীন হবে। চলমান পুনঃখনন কাজ নিয়ে যে টালবাহানা চলছে তা পরিহার করে সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করা এখন সময়ের দাবী। তা নাহলে আবারও আন্দোলনে নামবে সচেতন সমাজের প্রতিনিধিরা। আর তা ভুলে গেলে কিন্তু চলবে না।

আরো সংবাদ