একটি দুর্ঘটনা কেড়ে নিল একটি পরিবারের স্বপ্ন। স্কুল শিক্ষক বাবা-মা হাড় খাটুনী পরিশ্রমে তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন একমাত্র মেয়েটিকে। বাবা-মার স্বপ্ন পূরনে মেয়েটিও ছিল বদ্ধপরিকর। স্কুল-কলেজে প্রথম হয়ে ভর্তি হয়েছিল সরকারি মেডিকেলে। সেখানেও মেধার স্বাক্ষর রেখেছিল সে। কিছুদিন পর চিকিৎসক হয়ে বের হওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু আকষ্মিক একটি দুর্ঘটনা সব স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার করে দিল। ফুটতে না ফুটতেই অকালে ঝরে গেলো একটি স্বপ্ন। মানসী তালুকদার মিতু। খুলনা সরকারি মেডিকেল কলেজের ২য় বর্ষের ছাত্রী। কলেজ হোস্টেলে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে দীর্ঘ সাতদিন ঢাকা মেডিকেলে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে গত রোববার দিবাগত রাতে মৃত্যুর কাছে হার মেনেছে সে। মিতুর বাবা ছাতকের পাইগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দিগেন্দ্র কুমার তালুকদার। মা গনিপুর উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক মৌসুমী তালুকদার।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সালে পাইগাঁও উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে গোল্ডেন এ প্লাস, ২০১১ সালে সিলেট সরকারি মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস পায় মিতু। ২০১২ সালে মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় উত্তির্ণ হয়ে খুলনা সরকারি মেডিকেলে ভর্তি হয় সে। মেডিকেলেও প্রথম হয়ে প্রথম বর্ষ থেকে ২য় বর্ষে উত্তির্ণ হয়। খুলনা মেডিকেলের শহীদ জননী জাহানারা ইমাম হলের ৪০৮ নং রুমে ছিল সে। গত ১২ জুলাই মঙ্গলবার সকাল ৮টায় সর্বশেষ ১৫ মিনিট মার সাথে কথা হয় তার। তখন মাকে জানায় ৯টায় তার ক্লাস শুরু হবে। গোসল করে প্রস্তুত হয়ে ক্লাসে যাওয়ার জন্য তাড়াতাড়ি ফোন রেখে দেয়। সাড়ে ৮টার দিকে গোসল করে কাপড় মেলে দিতে হলের ৪র্থ তলার ছাদে উঠে। অসাবধানতাবশত পা পিছলে ৪র্থ তলা থেকে ছাদের নীচে পড়ে যায়। অজ্ঞান অবস্থায় তাকে খুলনা মেডিকেলে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেলে আনা হয়। ঢাকা মেডিকেলে লাইফ সাপোর্টে এক সপ্তাহ মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে গত রোববার রাত ১টার দিকে মৃত্যুর কাছে হার মানে মিতু। সাথে সাথে মৃত্যু ঘটে স্কুল শিক্ষক এক দম্পতির দীর্ঘদিনের পরিশ্রমে গড়ে তোলা একটি স্বপ্নের। সামান্য আয়ের মানুষ এ শিক্ষক দম্পতি জীবনের সকল উপার্জন মেয়েটির পিছনে ব্যয় করেছেন। মেয়েটিকে ডাক্তার বানানোর স্বপ্নে ছিলেন বিভোর। শিক্ষক দিগেন্দ্র তালুকদার এলাকায় একজন শক্ত সামর্থ, ঋজু আর ব্যক্তিত্ববান মানুষ হিসেবে পরিচিত। জীবনের একমাত্র অবলম্বন মেয়েটিকে হারিয়ে তার বুকে এখন আর কোন স্বপ্ন নেই। আছে বুকফাটা আর্তনাদ আর চোখ ভরা অশ্রু। এ শোকের ভার যে কি কঠিন। পৃথিবীর সবচেয়ে ভারি বস্তু পিতার কাধে সন্তানের লাশ। আর সেটা যদি হয় মিতুর মত কোন মেধাবী সন্তানের, তবে সেটা বহন করা আরো কঠিন হয়ে উঠে। জাউয়াবাজার থেকে আমাদের নিজস্ব সংবাদ দাতা রাজ উদ্দিন জানান, মেধাবী এ ছাত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যুর খবর শুনে জাউয়া এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। স্কুল শিক্ষক এ দম্পতির ছাত্রছাত্রী ও মিতুর সহপাঠিরা খবর পেয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। মিতুর জন্মস্থান জাউয়া খিদ্রাকাপনের মানুষ সাবার প্রিয় এ পরিবারের দু:সংবাদ যেন মেনে নিতে পারছেননা। গতকাল মিতুর স্কুল পাইগাঁও উচ্চবিদ্যালয়ের উদ্যোগে এলাকার সর্বস্তরের ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকের উপস্থিতিতে জাউয়া বাজারে শোক র্যালী ও স্কুলে শোক সভা অনুষ্ঠিত হয়। মিতুর প্রিয় ক্যাম্পাস খুলনা মেডিকেলে সব ধরনের ক্লাস ও পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। আজ মঙ্গলবার থেকে মেডিকেলে ৩দিনের শোক ঘোষনা করা হয়। গতকাল সোমবার সকালে মিতুর লাশ এম্বুলেন্সযোগে ঢাকা থেকে তার পিতৃভূমি ধর্মপাশার করোয়াজান গ্রামে নেয়া হয়। এখানে রাতে তার শেষ কৃত্য অনুষ্ঠিত হয়।