AM-ACCOUNTANCY-SERVICES-BBB

সিয়াম সাধনা ও আত্মশুদ্ধির মাস মাহে রামাদ্বান

বিশ্বনাথ নিউজ ২৪ ডট কম :: জুন - ৩০ - ২০১৪ | ৫: ০১ অপরাহ্ণ

Pic000

মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ :

রমদ্বান হলো আত্মশুদ্ধির মাস, ধৈর্য্যরে মাস, সহানুভূতির মাস, কাম-ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎকর্য নামক ষড়রিপু বশীভূত করার মাস। রমদ্বান রহমতের মাস, মাহফিরাতের মাস, দোযখ থেকে নাজাতের মাস। রমদ্বান প্রতি বছর আসে পাপ-পঙ্কিলতায় জর্জরিত মানব জাতিকে সীমাহীন রহমতের ছায়ায় চির শান্তির আবাস জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দিতে।
এই সে মাস, যে মাসে নাযিল হয়েছে পবিত্র কোরআন, যে মাসে মোমিনের রিযিক বৃদ্ধি করে দেয়া হয়, যে মাসে প্রত্যেকটি ফরজ ইবাদতের সওয়াব অন্য মাসের চেয়ে সত্তরগুন বৃদ্ধি করা হয়, যে মাসে প্রতি রাতে আল্লাহ পাকের তরফ থেকে মাগফেরাত দানের কথা ঘোষণা করা হয়, যে মাসে কবরের আজাব বন্ধ করে রাখা হয়। মোট কথা আল্লাহ পাক রহমত বরকতের প্লাবন এনে দিয়েছেন এ মাসে। এ মাসে ইবাদত এত বেশী সওয়াব যা অন্য মাসে নেই।

মাহে রামাদ্বানের পরিচিতি
রমদ্বান চন্দ্র বর্ষের নবম মাস। এ মাসটিকে রামদ্বান নাম রাখার পিছনে অনেক কারণ রয়েছে। অবশ্য ভাষাবিদ ও মোফাসসেরিনদের মধ্যে এর অর্থ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। যেমন-
কেউ কেউ বলেছেন, রমদ্বান আল্লাহ পাকের সিফতী নামের মধ্যে একটি। কারণ, হযরত ইবনে মালেক (রাঃ) বলেন যে, রাসূল পাক (সাঃ) আমাকে রামদ্বানকে রমদ্বান বলতে নিষেধ করেছেন, তিনি আমাকে রমদ্বান মাস বলতে বলেছেন। আল্লাহ পাক কোরআন পাকে শাহরু রামাদ্বান অর্থাৎ রামদ্বান মাস বলে উল্লেখ করেছেন। এ মাসটি আল্লাহর মাস সেহেতু আল্লাহ পাক তাঁর সিফাতী নামের সাথে সম্পর্ক রেখে নাম দিয়েছেন রমদ্বান মাস। কেউ কেউ আবার রমদ্বানের ব্যাখ্যা অন্যভাবেও করেছেন। যেমন- আরবী ‘রমদ্বান’ শব্দটির মূল ধাতু হচ্ছে ‘রামাদ্ব’। এর অর্থ হলো- জ্বলন, দহন এবং রোদে তপ্ত ভূমি।
যেহেতু এই মাসে সূর্যের তাপে উঠের বাচ্চার পা গরম হয়ে যায়। মরুভূমির বালি, পাথর গরম হয়ে যায়। এই জন্য এই মাসটির নাম রাখা হয়েছে রমদ্বান। গরম পাথরকে ও রামদ্বান বলা হয়ে থাকে।
শরীয়তের দৃষ্টিতে রামদ্বান মাসে দিনের বেলা রোজা রাখার ফলে সারাদিন সকল প্রকার পানাহার ইত্যাদি থেকে বিরত থাকার কারণে মানুষের শরীরে এক প্রকার দাহ ও জ্বলনের সৃষ্টি হয়। সে গাত্রদাহ ও অন্তর্দাহকে সম্বল করে মহান আল্লাহ পাক বান্দার পিছনের পাপ রাশি তার গাত্রদাহের আগুনে জ্বালিয়ে ভষ্ম করে দেন, ক্ষমা করে দেন। সুবহানাল্লাহ! এ হচ্ছে অত্র মাসকে রমদ্বান করে নামকরণের স্বার্থকতা। এ মর্মে হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রয়েছে, হুজুর (সাঃ) ইরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহ্তিসাবের সাথে সমস্থ রামদ্বান মাস রোজা রাখবে তার অতীতের সকল গুনাহ্ ক্ষমা করে দেয়া হবে।” (বুখারী শরীফ)
আখেরাতের চিন্তায়, আল্লাহ পাকের আযাবের ভয়ে এবং এ মাসের ইবাদতের অশেষ সওয়াবের ঘোষণা শুনে মানুষের অন্তর স্পর্শকাতর হয়ে পড়ে। যেমন- গরমের দিনে সূর্যের তাপে মরুভূমি ও পাথর হয়ে যায়।
হযরত খলিল (রাঃ) বলেন, রমদ্বান শব্দটি রমদ্ব থেকে নেয়া হয়ে। রমদ্ব এমন বৃষ্টিকে বলা হয় যা হেমন্তকালে বর্ষিত হয়। এই বৃষ্টির কারণে যেহেতু গাছপালা, তরুলতা, খেজুর বাগান সব কিছু তরতাজা হয়ে নতুন প্রাণ স্পন্দনে জেগে উঠে, তদ্রুপ এই মাসের কঠোর সাধনায় মানুষের শারীরিক ও মানষিক সমস্থ গোনাহ বিধৌত হয়ে মানুষ শিশুর মত পবিত্র হয়ে যায়। সেহেতু এই মাসের নাম রামদ্বান রাখা হয়েছে। রামদ্বান লিখতে পাঁচটি অক্ষর লাগে। এর প্রতি অক্ষরই একটি বিশেষ শব্দের প্রতি নির্দেশ করে। যেমন-
‘রা’ তে রেদ্বা অর্থাৎ সন্তুষ্টি।
‘মিম’ এ মহব্বত অর্থাৎ আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি (ভালবাসা)।
‘দ্বোয়াদ’ এ জামিন অর্থাৎ আল্লাহ পাক জামিনদার।
‘আলিফ’ এ উলফত অর্থাৎ বন্ধুত্ব।
‘নুন’ তে আল্লাহপাকের নুর বুঝায়। রমদ্বান মাসে আল্লাহ বান্দার জন্যে এগুলো নিদিষ্ট করে রেখেছেন। সেহেতু এ মাসের নাম রামদ্বান।

রোজা কি ও কেন
রোজ শব্দটি হচ্ছে ফারসি। রোজার আরবী হল সাওম। ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের মধ্যে রোজা হল ২য় স্তম্ভ। সাওম শব্দের আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা। যেমন- আরবীতে বলা হয়, ‘সামাতির রিহ’- বাতাস থেমে গেছে। ‘সামাতিল খাইল’- ঘোড়া চলতে চলতে থেকে গেছে। মানুষ ও যখন কোন কোন কাজ করতে করতে থেমে যায়, তখন আরবী পরিভাষায় তাকে বলা হয় সায়েম।
শরীয়তের পরিভষায় ‘সাওম বা রোজা’ হচ্ছে -সুবহে সাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার খানা-পিনা, স্ত্রী সম্ভোগ ও   সকল প্রকার অশ্লিলতা  থেকে বিরত থাকা।

কেন এই সিয়াম সাধনা
মানুষের মধ্যে যে পশু প্রবৃত্তি বা কুপ্রবৃত্তি রয়েছে, সেগুলো মানুষকে অন্যায় করার জন্য উৎসাহ প্রদান করে। লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতাসহ সকল প্রকার পাপ জন্ম নেয়। এই কৃপ্রকৃতি থেকে আত্মরক্ষা তথা আত্মশুদ্ধি ও উন্নততর অনুসারী হওয়ার উদ্দেশ্যেই রমদ্বানের রোজার বিধান দেয়া হয়েছে। মানুষ যেন কুপ্রবৃত্তিকে দমন করে শরীয়তের প্রতিটি বিধানকে যথাযথভাবে পালন করে মহান আল্লাহর সীমাহীন রহমতের উপযুক্ত হতে পারে এই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই রমদ্বানের সিয়াম সাধনার বিধান দেয়া হয়েছে।

রোজার সংক্ষিপ্ত ইতিাহাস
মাজাহিরে হক এবং সীরাতুল মুস্তাফা (সাঃ) গ্রন্থে বর্ণিত রয়েছে যে, রমদ্বানের রোজা ফরজ হওয়ার পূর্বে উম্মতে মুহম্মদীর উপর কোন রোজা ফরজ ছিল কিনা এ ব্যাপারে ওলামায়ে কিরামের ভিতর মতানৈক্যের সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে বলেছেন যে, রমদ্বানের রোজা ফরজ হওয়ার পূর্বে কোন রোজ ফরজ ছিলনা। কিন্তু অন্যান্য ওলামায়ে কিরাম বলেছেন যে, উহার পূর্বে কিছু দিনের জন্য রোজা ফরজ ছিল। যা রমদ্বানের রোজা হওয়ার পর রহিত হয়ে হয়ে যায়। তবে উহার ভিতর ও মতবিরোধ রয়েছে দিন-তারিখ সম্পর্কে। অনেকের নিকট মহররম মাসের দশ তারিখের রোজা ফরজ ছিল। যাকে আশুরায়ে মুহররম বলা হয়। আর কিছু সংখ্যক ওলামায়ে কিরাম বলেছেন যে, আইয়্যামে বেজের রোজা অর্থাৎ চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ এ তিনটি রোজা ফরজ ছিল।
হিজরী দ্বিতীয় সনের শাবান মাসের মাঝামাঝি সময়ে কেবলা পরিবর্তন হওয়ার দশ দিন পর পবিত্র রমদ্বান মাসের রোজা ফরজ করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, “হে ঈমান্দারগণ! তোমাদের প্রতি রোজাকে ফরজ করা হয়েছে যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পারো।” (২ঃ১৮৫)

ইসলামের প্রথম যুগের রোজা
মাহান আল্লাহ এমন বিধান মানুষের উপর চাপিয়ে দেননি যা মানুষের সাধ্যের বাহিরে। মানুষের উপযোগী করেই ইসলামের প্রতিটি বিধান তৈরী করা হয়েছে। তা পালন করা যেমন কষ্টকর বিষয় নয়। মহব্বত ও আন্তরিকতা থাকলেই অনায়াসে সমস্থ আদেশ পালন করা যায়। স্থান, কাল ও পাত্র ভেদে আল্লাহপাক ইসলামের বিধান পরিবর্তন-পরিবর্ধন ও সংযোজন-বিয়োজন করে ইসলামকে সময়োপযোগী পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হিসেবে মনোনীত করেছেন।
রোজা ফরজ হওয়ার সমসাময়িক দিনগুলোতে নিয়ম ছিল, সারাদিন রোজা রাখার পর ইফতার করার সময় থেকে ঘুমাবার পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত খানা-পিনা ও স্ত্রী মিলনের অনুমতি ছিল। একবার ঘুমিয়ে পড়লে সাথে সাথে সব কিছু নিষিদ্ধ হয়ে যেত। এ ব্যাপারে অনেক সাহাবী অসুবিধার সম্মুখীন হন। একদা কায়েস বিন সারমাহ নামক জনৈক আনসারী (রাঃ) সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করে ইফতারের সময় নিজ ঘরে ফিরে দেখেন ঘরে খাবার কোন কিছু নেই। স্ত্রী বললেন, আপনি একটু অপেক্ষা করেন আমি কারো কাছ থেকে কিছু সংগ্রহ করে আসার চেষ্টা করি। স্ত্রী খাবার কিছু সংগ্রহ করে বাড়িতে ফিরে দেখতে পেলেন তিনি দিনের কষ্ট, পরিশ্রমের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছেন। ইফতারের পর ঘুমিয়ে পড়ার দরুন খানা-পিনা তাঁর জন্য হারাম হয়ে যায়। ফলে, তিনি পরদিন কিছু না খেয়েই রোজা রাখেন। কিন্তু দুপুর বেলা পরিশ্রমের ক্লান্তিতে দূর্বল হয়ে পড়ার কারণে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান।
আবার কোন কোন সাহাবি ঘুমিয়ে পড়ার পর গভীর রাত্রে স্ত্রীর সান্নিধ্যে গমন করার দরুণ যথেষ্ট মানষিক কষ্টে নিপাতিত হন। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আয়াত নাযিল হয়।
“তোমাদের জন্য বৈধ করা হয়েছে তোমাদের স্ত্রীদের সাথে রোজার রাত্রে সম্ভোগ করা। তারা তোমাদের জন্য পরিচ্ছদ। আল্লাহ জ্ঞাত আছেন, তোমাদের নিজেদের প্রতি অবিচার করতে ছিলে। অতঃপর তিনি তোমাদের প্রতি ক্ষমাশীল হয়েছেন এবং তোমাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। সুতরাং এখন তোমরা তাদের যা কিছু আল্লাহ দান করেছেন তা আহরণ কর। আর খানা-পিনা কর, যতক্ষণ না কাল রেখা থেকে ভোরের শুভ্র রেখা স্পষ্ট দেখা যায়।” (২ঃ১৩৭)
পক্ষান্তরে রোজা ফরজ হওয়ার প্রারম্ভে এ অনুমতিও ছিল যে, ইচ্ছে করলে রোজা না রেখে ফি দিয়ে আদায় করে নিতে পারত। কিন্তু পরবর্তীতে তা রহিত করে রমদ্বানের রোজা রাখাকেই ফরজ করা হয়েছে, অপরিহার্য বিধান করা হয়েছে। “সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে সে এ মাসের রোজা রাখবে।” (২ঃ১৮৫)
তবে ফি দিয়ে দেয়ার বিধান শরীয়তে এখনও বহাল রয়েছে একমাত্র অতি বার্ধক্যজনিত কারণে দুর্বল ও চির রোগীদের বেলায়। তারা প্রতিটি রোজার বিনিময়ে একজন দরিদ্র লোককে দু’বেলা পেট ভরিয়ে তৃপ্তিসহকারে খেতে দিবে।

রামদ্বানের মর্যাদা ও গুরুত্ব
রামদ্বানের সিয়াম সাধনার মর্যাদা ও গুরুত্ব যে কত বেশী নিম্নের এই হাদিসে কুদসীর প্রতি লক্ষ্য করলেই বুঝা যায়। আল্লাহ পাক বলেন, মানুষের প্রতিটি কাজের ফল আল্লাহপাকের দরবারে কিছু না কিছু বৃদ্ধি পায়। একটি নেক কাজের জন্য দশগুন থেকে সাতশতগুন পর্যন্ত দেয়া হয়। অর্থাৎ তার চেয়েও বেশী কিন্তু আল্লাহপাক বলেন, রোজাকে এর মধ্যে গন্য করা যাবেনা। কারণ, রোজা একমাত্র আমার জন্যই রাখা হয়, আর আমিই এর প্রতিদান দেব।
হুযুর (সাঃ) এরশাদ করেন, পবিত্র রামদ্বান মাসে বেহেশতকে অপূর্ব সুঘ্রানে সুরভিত করা হয়।
হযরত সালমান ফারসি (রাঃ) থেকে বর্ণিত, “রাসূল (সাঃ) বলেন, যে রমদ্বান মাসে নফল এবাদত আদায় করবে অন্য মাসের ফরজ এবাদতের সমতুল্য সওয়াব পাবে এবং যে ব্যক্তি রমদ্বান মাসে একটি ফরজ আদায় করবে সে অন্য মাসের সত্তরটি ফরজ আদায় করার সমপরিমাণ সওয়াব পাবে।” (মশকাত ঃ ১/১৭৩)
বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রমদ্বান মাসের জন্য বেহেশতকে সুসজ্জিত করা হয়। যখন রমদ্বান মাসের প্রথম রাত্র আগমন করে তখন আরশের তলদেশ হতে একটি সুমধুর হাওয়া বইতে থাকে। যা প্রবাহে জান্নাতের পাতা পল্লব ও দরজার কড়া সমূহ হেলতে আরম্ভ করে। যার কারণে এমন এক মনমুগ্ধকর ও হৃদয়স্পর্শী সুর উত্থিত হয় যে, শ্রোতারা ইতিপূর্বে কখনও এরূপ আর শুনতে পায়নি। তখন বেহেশতের হুরসমূহ আত্মপ্রকাশ করে জান্নাতের বালাখানা সমূহের মধ্যে কেউ দাঁড়িয়ে ঘোষণা করতে থাকে, “আল্লাহর কোন প্রিয় বান্দা আছে কি? যারা আমাদের সঙ্গে বিয়ে হবার জন্য আল্লাহর দরবারে দরখাস্ত করবে?”
তারপর জান্নাতের হুরবালাগণ জান্নাতের প্রহরী রিদওয়ানের নিকট জিজ্ঞাসা করবে, ইহা কোন রাত্রি? তদুত্তরে তিনি বলেবেন, ইহা রমদ্বানের প্রথম রাত্রি। মুহাম্মদ (সাঃ) এর রোজাদার উম্মতের জন্য জান্নাতের দ্বারসমূহ খুলে দেয়া হয়ছে। হুযুর (সাঃ) বলেন, আল্লাহপাক রিদওয়ানকে বলবেন, আহমদ (সাঃ) এর রোজাযাদ উম্মতের জন্য জাহান্নামের দরজা সমূহ বন্ধ করে দাও।……
সাহল ইবনে সাআদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেন, “জান্নাতের দরজা সর্বমোট আটটি। তার একটি দরজার নাম ‘রাইয়্যান’। যে দরজা দিয়ে একমাত্র রোজাদার ব্যক্তিই প্রবেশ করতে পারবে।” (মোশকাত ঃ ১৭৩)
আল্লাহ প্রদত্ত ইসলামের প্রতিটি বিধান এবং মহানবী (সাঃ) এর সকল সুন্নত ও আদর্শ উৎকর্ষে ভরপুর বিশ্ব মানবতার কল্যাণকর। শারীরিক-আত্মিক, ইহলৌকিক ও পরলৌকিক যাবতীয় কল্যাণ ও উপকারের সমাহার। অনেক সময় আমরা জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ও অনভিজ্ঞতার কারণে এটাকে খাটো করে দেখার অবকাশ পাই, অথচ বাস্তব তা নয়।
রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর নিকট মৃগনাভি ও কস্তুরী অপেক্ষা অধিক পছন্দনীয়। রোজ মানুষের ঢাল স্বরূপ। অতএব, তোমাদের কেউ রোজা রাখলে অশ্লীল কথাবার্তা বলবে না এবং অনর্থক উচ্চস্বরে বলবেনা। আর যদি কোন (অজ্ঞমূর্খ) লোক তাকে গালমন্দ করে বা তার সাথে ঝগড়াঝাটি করতে ইচ্ছে করে, তবে তার উচিত যে, সে একথা বলে দিবে,“আমি রোজাদার”। (মোশকাত ঃ ১/১৭৩)

অভিজ্ঞ চিকিৎসকের মতামত
অভিজ্ঞ চিকিৎসকগণ বলেন যে, সর্বক্ষণ আহার, সীমাতিরিক্ত ভোজন ও দূষিত খাদ্য খাওয়ায় শরীরে এক প্রকার বিষাক্ত উপকরণ ও উপাদানের সৃষ্টি হয় এবং জৈব বিষ (ঞড়ীরহ) জমা হয়। যার কারণে দেহের নির্বাহী ও কর্মসমপাদন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো বিষাক্ত উপকরণ ও জৈব বিষ দমনে অক্ষম হয়। ফলে তখন জটিল ও কঠিন রোগের জন্ম হয়। দেহের মধ্যকার এহেন বিষাক্ত ও দূষিত উপাদানগুলো অতিদ্রুত নির্মূল করণের নিমিত্তে পাকস্থলীকে মাঝে মধ্যে খালি করা একান্ত প্রয়োজন। রোজাই এর একমাত্র সহায়ক। যার বিকল্প কল্পনা করা যায় না।
১৯৬০ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ডাঃ গোলাম মোয়াজ্জেম কর্তৃক ‘মানব শরীরের উপর রোজার প্রভাব’ শীর্ষক গবেষণামূলক নিবন্ধ অনুযায়ী জানা যায়, রোজা দ্বারা শরীরের ওজন সামান্য হ্রাস পায় বটে, তবে তা শরীরের কোন ক্ষতি করেনা। বরং শরীরের মেদ কমাতে রোজা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের খাদ্য নিয়ন্ত্রণ অপেক্ষা অধিক কার্যকর। তাঁর পরীক্ষা নিরীক্ষার আলোকে আরও জানা যায় যে, যারা মনে করেন রোজা রাখলে শূল-বেদনার প্রকোপ বৃদ্ধি পায়, তাদের এ ধারণা সঠিক নয় বরং ভোজনে তা বৃদ্ধি পায়।
পাকিস্তানের প্রবীন প্রখ্যাত চিকিৎসক ডাঃ মোহাম্মদ হোসেনের নিবন্ধ হতে জানা যায় যে, যারা নিয়মিত সিয়াম পালন করে সাধারণত তারা বাতরোগ, বহুমুত্র, অজীর্ণ, হৃদরোগ ও রক্তচাপজনিত ব্যধিতে আক্রান্ত কম হন।
এছাড়া ডাঃ ক্লাইভসহ অন্যান্য চিকিৎসাবিজ্ঞানী পর্যন্ত স্বীকার করেছেন যে, ইসলামের সিয়াম সাধনার বিধান স্বাস্থ্যসম্মত এবং ফলপ্রসূ। আর তাই মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার রোগ-ব্যাধি তুলনামূলকভাবে অন্য এলাকার চেয়ে কম দেখা যায়। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ‘কম খাওয়ার জন্য বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। ক্ষুধা লাগলে খেতে বলেছেন এবং ক্ষুধা থাকতে খাওয়া বন্ধ করার জন্য উপদেশ দিয়েছেন, যা চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্মত। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে দীর্ঘজীবন লাভ করার জন্য খুব বেশী খাওয়ার প্রয়োজন নেই। বহুল আলোচিত প্রবাদ বাক্যটি মূলত বাস্তবভিত্তিক- ‘বেশী বাঁচবিতো কম খা’।

ইফতারের ফজিলত
হুজুর (সাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি রমদ্বান মাসে কাউকে ইফতার করাবে, তার যাবতীয় গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে এবং জাহান্নাম থেকে মুক্ত করা হবে এবং রোজাদারের ন্যায় সওয়াবের অধিকারী হবে। অথচ রোজাদারের কোন সওয়াব কম করা হবে না। সাহাবীগণ আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আমাদের মধ্যে সকলে এমন নয় যে, তারা রোজাদারকে তৃপ্তি সহকারে ইফতারী করাতে পারে। তখন হুজুর (সাঃ) বললেন, উল্লেখিত সওয়াব ঐ ব্যক্তিকে দিবেন, যে লোক রোজাদারকে এক ঢোক দুধ বা একটি খেজুর অথবা এক ঢোক পানি দ্বারা ইফতারী করাবে। আর যে লোক কোন রোজাদারকে তৃপ্তি সহকারে খানা খাওয়াবে, আল্লাহ তাআ’লা তাকে আমার হাউজে কাউসার থেকে এমন তৃপ্ত করে পানি পান করাবেন যে, সে (এরপর) জান্নাতে প্রবেশ না করা পর্যন্ত পিপাসা অনুভব করবে না। সুবহানাল্লাহ! এ মাসের প্রথম দশক রহমত, দ্বিতীয় দশক মাগফেরাত এবং শেষ দশক জাহান্নাম থেকে নাজাত এর জন্য নির্ধারিত এবং যে লোক নিজের দাস-দাসীর কাজের বোঝা হালকা করে দিবে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিবেন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি করে দিবেন। (বায়হাকী, মেশকাত ঃ ১/১৭৩)

সাওমের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
সকল ইবাদতের মূল উদ্দেশ্য মহান স্রষ্ঠার সন্তুষ্টি অর্জন। তাঁর সন্তুষ্টি এবং নারাজি থেকে দূরে থাকা এবং দুনিয়া ও আখিরাতের যাবতীয় সুখ, শান্তি ও কল্যাণের অধিকারী হওয়ার প্রচেষ্টা করা। এছাড়াও দ্বীনি ও আত্মিক উপকার রয়েছে যা অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ।
১। রোজা রাখার কারণে আত্মার অস্থিরতা বিদুরিত হয়। শান্তি অনুভব করে। আর এটাই রোজার লক্ষ্য।
২। রোজার কারণে অন্তরের কালিমা ও ক্রোধ তথা পঙ্কিলতা প্রভৃতি পরিস্কার হয়ে যায়।
৩। রোজা রাখার কারণে অসহায়, ক্ষুধার্ত, অনাত, অভাবে জর্জরিত ও আর্তমানবতার প্রতি দয়া, কৃপা, সমবেধনা ও সহযোগীতার পথ উন্মুক্ত হয়, প্রশান্ত হয়। কেননা, যে লোকটি ক্ষুধার জ্বালা জীবনে কোন সময় বরদাশত করেনি, সহ্য করেনি সে কখনও গরীব-দুঃখীর জ্বালা বুঝবেনা এবং সাহায্য ও সহযোগীতা করার প্রয়োজনবোধ করবেনা।

বস্তুত দরিদ্র, নিপীড়িত ও ক্ষুধার্ত মানবতার প্রকৃত অবস্থাদি অনুধাবন করতঃ তাদের স্ব-স্ব দাবী পালনের নিমিত্তে ব্রতী হওয়াই রোজার উদ্দেশ্য। আর এ জন্যই পবিত্র মাহে রমদ্বান সকল মহলের জন্য আশীর্বাদ ও করুণা স্বরূপ।
আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে মাহে রমদ্বানের আদব রক্ষা করে আন্তরিকভাবে ইবাদত করার তৌফিক দান করুন। আমিন! আমিন!

তথ্যসুত্র ঃ
মাহগ্রন্থ আল কোরআন বুখারী শরীফ বায়হাকী শরীফ মেশকাত শরীফ সিরাতুল মুস্তাফা (সাঃ) মাসিক পরওয়ানা মাসিক মদিনা দৈনিক ইনকিলাব  তাসনীমে কুরআন।

লেখক ঃ শিক্ষক, আলহাজ্ব মিনা বেগম নুরানীয়া আলিম মাদরাসা, তাজপুর, ওসমানীনগর, সিলেট। মোবাইল : ০১৮১৮৪৩৬৩৫০

আরো সংবাদ